Bansona and Auleshwar Shiva
বাণসোনা। গাজনের শিবের ভক্তদের কাছে পরম আদরের তৈলসিন্দুরে চর্চিত কাষ্ঠনির্মিত দণ্ডাকার মূর্তি। বরেন্দ্রের স্থানবিশেষে তাঁর পরিচয় আদম গাদম। আর পুণ্ড্র ও রাঢ়ের বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষ তাঁকে বলে বাণসোনা। কিন্তু কে এই যোদ্ধা? আর কেনই বা গাজনের প্রতি ক্ষেত্রে তাঁর অমোঘ উপস্থিতি? কেন তাঁর নামাঙ্কিত দণ্ড নিয়ে শিবের ভক্তদের এত উন্মাদনা?
আবহমান কাল ধরে লোকমানসে চলে আসা কিংবদন্তি অনুযায়ী এই মূর্তি রাজা বাণের। পুরাণে যিনি কৃষ্ণবিদ্বেষী কিন্তু পরম শৈব বাণাসুর। পুরাণপ্রসিদ্ধ বলি রাজার পুত্র তথা জরাসন্ধ নরকাসুর পরবর্তী মহাভারতের যুগে সমগ্র পূর্বভারতের একচ্ছত্র অধিপতি বাণাসুর। পুরাণ অনুসারে ঐকান্তিক ভক্তির কারণে তিনি শিবের মানসপুত্র রূপে শিবভক্তদের প্রধানতম পথপ্রদর্শক ছিলেন। আজও বঙ্গের সমস্ত প্রাচীন শিবমন্দিরে স্ফটিক ও অন্যান্য শ্বেত কৃষ্ণ লোহিত বর্ণের প্রস্তরের ক্ষুদ্র শিবলিঙ্গকে এই বাণ রাজার আরাধিত জ্ঞানে বলা হয় বাণলিঙ্গ বা বাণেশ্বর। আজও মালদহের আদ্যের গম্ভীরা শুরু হয় আদিনাথ মহেশের জয়ধ্বনি দিয়ে এবং বাণরাজার গুণকীর্তন করে।
গুপ্তযুগের আগে পর্যন্ত শৈবধর্মের মূল ধারায় প্রকৃতিমাতৃকার ধারণা খুব একটা প্রচলিত ছিল না। শৈবধর্মের একটি শাখা পাশুপত ধর্মেই শুধু সাঙ্খ্যযোগের ধারণা প্রবেশ করেছিল। এই বিষয়ে সম্ভবত লকুলীশ বা নকুলীশ নামক এক অবতারকল্প সাধকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেই কারণেই প্রাচীন সতীপীঠসমূহে ভৈরবদের দেবীপীঠের দ্বাররক্ষী রূপে কল্পনা করা হয়েছিল। এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে কালীঘাটের মা কালীর সুপ্রাচীন পীঠের ভৈরবের নাম নকুলীশ। গুপ্তযুগ থেকে শৈবধর্মে চণ্ডী উমা প্রভৃতি রূপে মাতৃকার ধারণা ক্রমশঃ বলবতী হতে থাকে। সেই সময় শিব ও শিবপত্নীর যুগলরূপকে বাণ নামে নামাঙ্কিত করে শৈবধর্মের পটপরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা নেন শশাঙ্ক।
বৈরাগী প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন শিবকে এক দেবীর সাথে যুগলে উপাসনার এই রীতি নিঃসন্দেহে প্রকৃতিপরায়ণ বাঙালির সংস্কৃতির আদিরূপের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় বলেই বিবেচনা করা উচিত। এই মূর্তির সাথে অতীতের কিংবদন্তি বাণরাজা এমনভাবে জড়িয়ে আছেন; যে শিবের এই যুগল রূপকে বাণ বা বাণেশ্বর বলেই উল্লেখ করা হয়। দারিদ্র্যদুঃখদহন ও অপার করুণার জন্য এই বাণরূপী শিবের বিগ্রহের প্রসিদ্ধি আছে। বাণের পূজাকালে যে ধ্যানমন্ত্র বলা হয় তা নিঃসন্দেহে শিবের তন্ত্রসম্পৃক্ত রূপের আদিতম প্রকাশ। এখানে শিব প্রমত্ত; শক্তিসংযুক্ত; সংসারবন্ধন দহনে সমর্থ; শৃঙ্গারের আদিরসের উল্লাস তাঁর মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। অতএব এই বাণের উপাসনা গৌড়বঙ্গের আদি চর্যা তন্ত্র তথা সংসারচক্র থেকে মুক্তির জীবনদর্শন সাঙ্খ্য উভয়ের দ্বারাই সম্পৃক্ত।
শশাঙ্কের সময় যে প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন শৈবধর্মকে প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল; তার চিহ্ন আজও এই চৈত্রমাসের শেষের লোকায়ত উৎসবসমূহে বিদ্যমান। নববর্ষের আগের দিন নীলষষ্ঠীর ব্রতের সাথে নীলাবতী ও মহাদেবের বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রচলন তারই দৃষ্টান্ত। বাণরূপী মহাদেবের ধারণা তাঁর সময়ে এতটাই জনপ্রিয় হয়; যে শশাঙ্ক যুগের পর গোটা ভারতে আর কোথাও গৌরীপট্ট ছাড়া শিব নির্মিত হয়নি। সেখানে গৌরীপট্ট ছিল আদিমাতৃকার প্রতীক। লিঙ্গরূপ শিব যেন সেই মাতৃকার কোলে শিশুর মতো বিরাজমান। ঠিক এই ভাবনাই দেবী শিবকে কোলে নিয়ে থাকা দেবী তারার মূর্তিতে প্রকাশিত। আবার শশাঙ্কের বহু পরে সেনযুগে কবি জয়দেব যখন গীতগোবিন্দে রাধার কোলে ভীত শিশু কৃষ্ণকে পরম নির্ভরতা লাভ করতে দেখে রাধামাধবোর্জয়ন্তি বলে উল্লসিত হচ্ছেন; তখনও এই ভাবনাই এক মধুর রূপ লাভ করেছে।
সুতরাং শশাঙ্কের সময় থেকে প্রকৃতিমাতৃকাকে স্বীকার না করার শৈবধর্মের আর কোনো পথ ছিল না। আদিমাতৃকার পুত্র/সেবক/ সহচর এবং মাতৃকার সহচরী দেবী নীলাবতীর সাথে যুগলরূপে অবস্থিত; এই সাধনদর্শনই হয়ে উঠেছিল শৈবধর্মের কেন্দ্রীয় ভাবনা।
রাঢ়ের আলেরকোমভীরাবর্ণ নামক প্রাচীন পদটি থেকে আমরা জানতে পারি শশাঙ্কের সময়ের শৈবধর্মের দার্শনিক ভাবনা। সেখানে মহাযানের শূন্যতত্ত্বকে যুগলসাধনার আনন্দসাগরে ডুবিয়ে ষাঁড়ের পিঠে বাণ অর্থাত্ শিব ও তাঁর শক্তির যুগল রূপকেই মূল উপাস্য রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বাণমূর্তির সাধনা করলে শূন্যতত্ত্বের প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতার জটিলতা সহজেই লুপ্ত হয়। তাই
বসুয়ার পৃষ্ঠে দেওনি বাণ
সোনার ঝিঞ্ঝ্বিরি নিয়ে পলান
এবার বাণসোনা মূর্তির বিশেষত্বের দিকে একটু লক্ষ করা যাক। এই মূর্তির বৈশিষ্ট্য হল: মাথায় জটা। শ্মশ্রুবিহীন মুখ। প্রশস্ত বক্ষ। দেহের নিম্নাংশ খোদিত না হলেও দণ্ডের ঋজূতার দ্বারা দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা যথাযথভাবেই প্রকাশিত। আর এই দণ্ডের দুই পাশ থেকে বেরিয়ে থাকা তীক্ষ্মাগ্র কীলক সম্ভবত বাণরাজা অথবা তাঁর উত্তরসূরি শশাঙ্কের সমরনৈপুণ্যের দ্যোতক। আবার এমনও হতে পারে ; গঙ্গারিডি সভ্যতার মাতৃকার যোদ্ধৃ রূপ বোঝাতে যেমন কবরীর মধ্যে পাঁচ বা দশটি তীক্ষ্ম আয়ুধ সজ্জিত করা হত; সেই একই ভাবনা এই বাণসোনা মূর্তিতেও প্রযুক্ত হয়েছে। হয়তো অতীত সভ্যতার সাংস্কৃতিক স্মৃতি ষষ্ঠ শতাব্দীর বাঙালির চেতনায় তখনও বলবৎ ছিল। তাই প্রকৃতিমাতৃকার অনুচর রূপে বাণমূর্তির কল্পনাতেও এইভাবে দৃঢ় দেহকাণ্ডে তীক্ষ্ম আয়ুধের সমাহার ঘটেছে।
এই বাণমূর্তির উপাসনার ব্যাপারে পুণ্ড্র রাঢ় বরেন্দ্র গৌড়ের কোন ভেদ নেই। এই বাণসোনা যে শুধুই শশাঙ্কের উপাস্য নন; বরং তাঁর গৌড়তন্ত্রের রাজপ্রতীকও বটে; তাও সহজেই বোঝা যায়। আজও গাজন আর চড়কের দিনগুলিতে সকাল থেকে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত শিবের 'ভক্ত'গণ বাণসোনাকে কাঁধে নিয়ে নৃত্য করতে করতে ঘুরে বেড়ান গ্রামের গৃহে গৃহে। গ্রামবাসীগণ সাধ্যমতো সিধে দেন বাণসোনার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে। এইসময় যে ফল দেওয়া হয় তা ভক্তেরা গেঁথে দেন বাণসোনার কীলকগুলিতে। তারপর হাতের বেত্রদণ্ড দিয়ে স্পর্শ করেন গৃহের সকল বৃক্ষরাজি আর গৃহস্থের মস্তকে। প্রচলিত বিশ্বাস এই বেতের লাঠির স্পর্শে গৃহস্থের কল্যাণ হয়। হয়তো সেই সাক্ষীহীন অতীতের প্রজাপালক গৌড়াধীপ শশাঙ্কের প্রজাহিতৈষী শাসনদণ্ডেরই উত্তরাধিকার বহন করে এই বেত্রদণ্ড। হতে পারে ধূসর অতীতে শশাঙ্কের অধীনস্থ আঞ্চলিক প্রতিনিধিগণই গাজন পরিচালনা করতেন। ভক্তদের ভরণপোষণের জন্য এলাকাবাসীগণের কাছে কর হিসেবে সংগ্রহ করতেন তণ্ডুল সব্জি ও ফল (বিশেষতঃ নারকেল ও আম)। সেই প্রথাই আজও এই ভক্তগণের গ্রাম প্রদক্ষিণের রীতির মধ্যে বহমান।
বাণসোনা নামটি বাণ আর শূন্য এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। সোনা বা শূন্যতত্ত্বের উপরে প্রকৃতিপরায়ণ বাণ বিরাজমান। তাই নাম বাণসোনা। এই মূর্তির মাধ্যমে শুধু যে শৈবধর্মে তন্ত্রের প্রাবল্য সঞ্চারিত হয়েছিল তাই নয়; মহাযানের শূন্যতত্ত্ব ও করুণাকেও আত্তীকৃত করা হয়েছিল। যে বৌদ্ধধর্ম তার থেরবাদী রূপে প্রকৃতি থেকে বিযুক্তি বা উচ্ছৃতিকেই নির্বাণের মার্গ বলে গণ্য করত; সেই বৌদ্ধধর্মে কালক্রমে বজ্রযান ও সহজযানের উদ্ভব কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। ধাপে ধাপে এই উত্তরণ ঘটেছিল। মহাযানে যখন অসঙ্গ প্রথম তন্ত্রাচারকে স্থান দিলেন; যে সময় আদি সাঙ্খ্যের সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনি করে জগতের কল্যাণে নির্বাণসুখ ত্যাগ করে অবলোকিতেশ্বর মহাযানে উপাসিত হতে থাকলেন; সেটি ছিল এই পথের প্রথম ধাপ। আর শশাঙ্কের সময় যখন মহাযানের শূন্যতত্ত্বকে অভিষিক্ত করল তন্ত্রের আনন্দময় সাধনমার্গ; বাণ যখন যুক্ত হলেন শূন্যের সাথে; তখনই নিগূঢ় দার্শনিক তত্ত্বের উচ্চতা থেকে মহাযান ও শৈবতন্ত্রের একীভূত রূপ নেমে এল গণচেতনার ভূমিতে। এটিকে আমরা দ্বিতীয় ধাপ বলে গণ্য করতে পারি।
আলেরকোমভীরাবর্ণ পদে বলা হয়েছে:
আট পাটকাঠি বর্ণ
আলের কোমভীরা বর্ণ
আর বর্ণ সরস্বতীর গান
শীতলার বর্ণ গোঁসাই যাও জল্লিবাণ
অর্থাত্ শ্বেতবর্ণ অষ্টদল যে কমল কুম্ভকের মাধ্যমে দেহতত্ত্বে সাধক দর্শন করেন; যেখানে সরস্বতীর গান অর্থাত্ তিন নাড়ির পথে প্রণবনাদ ধ্বনিত হয়; শীতলার বর্ণ অর্থাত্ নীলবর্ণ শূন্যতত্ত্ব সেই বাণের আনন্দ সমুদ্রে নিমজ্জিত হোক।
এ যেন সহজযানের চর্যারই পূর্বাভাস। গাজনের প্রাণস্বরূপ এই শৈবতন্ত্র এভাবেই মহাযান থেকে বজ্রযান ও সহজযানের আগমনকে ত্বরান্বিত করেছিল। হয়তো বুদ্ধগয়ার থেরবাদী হীনযানী বৌদ্ধদের সাথে শশাঙ্কের সংঘাতের মূলও নিহিত আছে এখানেই। শশাঙ্ক শুধুমাত্র হীনযানীদের প্রধান কেন্দ্র বুদ্ধগয়া আক্রমণ করলেন; অথচ নালন্দা সহ গৌড় ও মগধের একটিও মহাযানী বিহার আক্রান্ত হল না; এ বোধহয় নিছক কাকতালীয় নয়। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার অবকাশ আছে। গাজন ও চড়কের মধ্যে দিয়ে শশাঙ্কের শৈবধর্মের বহিরঙ্গে শৈব; অন্তরঙ্গে প্রকৃতিমাতৃকার পূজারী তান্ত্রিক; এই অপূর্ব সাধনতত্ত্ব আজও বাঙালির লোকায়ত থেকে অভিজাত সমস্ত শ্রেণীর হৃদয়ের সম্পদ হয়ে আছে।
Comments
Post a Comment