Charak Puja
চড়ক উৎসবঃ বাঙালির শিকড়
সবার প্রথমে দেখা যাক চড়ক কী? শিবকে কেন্দ্র করে বাঙালি হিন্দুদের এক ধর্মীয় উৎসব। যার সূত্রপাত চৈত্রের প্রথম দিন থেকে সন্ন্যাস গ্রহণের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এবং চৈত্রের শেষ দিন চড়কের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। আগেরদিন আগে থেকে জলে ভিজিয়ে রাখা শালগাছের গুড়িকে মাটিতে পোঁতা হয়। একে বলা হয় গাছ জাগানো যা থেকেই “গাজন” শব্দটি এসেছে বলে মনে করেন অনেকেই। তবে ‘গাজন’ শব্দের আরও অন্য উৎপত্তির কারণ জানা যায়। চড়কের দিন সেই গাছে সন্ন্যাসীরা নিজের বেঁধে শূন্যে চক্রাকারে ঘোরেন। চড়কির মত এই ঘোরা থেকেও চড়ক শব্দটি এসে থাকতে পারে। এই দিনের প্রধান আকর্ষণ হলো সন্ন্যাসীরা নানা ভয়ানক কাণ্ড কারখানা করে থাকেন। নিজেকে শলাকা বিদ্ধ করেন, চক্রাকারে ঘোরার সময় বড়শি দিয়ে নিজেকে আটকে রাখেন মোদ্দা কথা নিজেকে কষ্ট দেন।
চড়কের প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে যদি যাবতীয় পূজার দিকে তাকাই তো দেখা যাবে সর্বত্রই নিজেকে কষ্ট দিয়ে ঈশ্বরকে খুশি করার প্রয়াস। তার প্রথম শুরুটা না খেয়ে পুজো দেওয়া থেকে হয়। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে শিবের মাথায় জল ঢালাতে কষ্ট নেই? ‘ধর্মপুরাণে’ দেখি লাউসেন নিজের শররীরকে খন্ড খণ্ড করে ধর্মের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করছেন কারণ তিনি চাইছেন কৃপা লাভ করতে। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা কাঁটা বিছিয়ে সেই পথে হাঁটা অভ্যাস করছে এই কান্ড কারখানাগুলো ঈশ্বরের প্রতি প্রেমের প্রকাশ ছাড়া তো আর কিছুই নয়। আমরা অনেকেই ভালোবাসার মানুষের নাম হাতে খোদাই করি। তাতে কি শরীরের কষ্ট হয় না? নাকি অনেকেই হাত কেটে প্রেমের পরীক্ষা দেয় না? সবেতেই উচ্চবিত্ত, উচ্চবর্ণের ফোবিয়া তৈরি করতে পারলে একশ্রেনীর মানুষের বিশেষ লাভ হয়। এর দ্বারা একটা মানুষকে খুব সহজেই শিকড় বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং শিকড় বিচ্ছিন্ন মানুষকে আপন প্রোজেক্টের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায়। বিভীষণ ছাড়া রামের পক্ষে রাবণকে হারানো সম্ভব নয়।
এবার আসা যাক চড়কের আচরণের প্রসঙ্গে। খেয়াল করলে দেখা যায় এই সন্ন্যাস গ্রহণ তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ করে থাকেন। এবং উচ্চবর্ণের মানুষ তাঁদের দেবতার বরপুত্র ভেবে প্রণাম করে যান। সুতরাং বর্ণাশ্রম প্রথাকে একেবারে ভেঙে ফেলার জন্য এই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। “হুতোম পেঁচার নক্সা” গ্রন্থে কালীপ্রসন্ন সিংহ “কলিকাতার চড়ক পার্বণ”-এ লিখছেন, “আমাদের বাবুর চার পুরুষের বুড়ো মূল সন্ন্যাসী কানে বিল্বপত্র গুঁজে হাতে একমুটো বিল্বপত্র নিয়ে, ধুক্তে ধুক্তে বৈঠকখানায় উপস্থিত হলো; সে নিজে কাওরা হলেও আজ শিবত্ব পেয়েচে, সুতরাং বাবু তারে নমস্কার কল্লেন......”। গ্রন্থটির প্রকাশ ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে। আজকের বিতর্কিত পোস্টে দাবি করা হয়েছে জমিদারদের শলাকাবিদ্ধের অত্যাচার শুরু হয় ১৮০০ সাল থেকে এবং ১৮৬৫ সালে ইংরেজদের আইনের কথা আনেন। অথচ এই সময় পর্বের মধ্যেই কালীপ্রসন্ন চড়ক নিয়ে এত কথা লিখলেন, কথায় কথায় ‘বাবুদের’ মজা ওড়ালেন তবু অত্যাচারের কথা বাদ দিয়ে দিলেন? যদি সত্যিই তেমন কিছু সেসময় হত তিনি কি বাদ দিতেন? কারণ গোটা গ্রন্থ জুড়ে দেখেছি উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবিত্তের ভুল ধরা, চরিত্রের অসংগতিকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটা সুযোগও হাত ছাড়া করেন নি। তিনি তাঁর নকশায় এত বড় ঘটনার কথা বাদ দেবেন তা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য?
কেবল বর্ণাশ্রম নয় নারী পুরুষের ভেদাভেদ-ও মুছে যায় এই একমাস ব্যাপী অনুষ্ঠানে। মেয়েরাও সন্ন্যাস নেয় এসময়। এবং এই অনুষ্ঠান কোনো ব্যক্তি দ্বারা নয় একটি গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হয়। কারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন একমাস ধরে হলেও মূলত তিনদিনের অনুষ্ঠান। প্রথমদিন অধিবাস, তারপরের দিন নীল, তার পরের দিন চড়ক। এই তিনদিনই সন্ন্যাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। নারীদের এরূপ যোগদান চর্যার স্বাধীনচেতা নারীদের কথা কি মনে করায় না? একটা ধারাবাহিকতা না থাকলে হঠাৎ করে মধ্যযুগে কিংবা তারপরে নতুন করে মেয়েদের বাইরে আসার প্রথা শুরু করা সম্ভব?
অনেক ট্রাইব জনজাতিকে আজও দেখা যায়, চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা যেভাবে নিজেদের কষ্ট দেয় ঠিক একইভাবে তারাও নানা উৎসবে নিজেদের শলাকা বিদ্ধ করে। ফলে চড়কের আচরণ থেকেই স্পষ্ট তার আদিমতা তাকে দুদিনের প্রথা বলে দাগিয়ে দিতে যথেষ্ট অবিবেচক হতে লাগে। এই অনুষ্ঠানের প্রাচীনতা সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝা গেলেও তথ্য প্রমাণ খানিক লাগে। বাঙালির ইতিহাসের যাবতীয় তথ্য প্রমাণকে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে সে সকলেরই জানা। তবু নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালির ইতিহাস’ গ্রন্থে সেনযুগেও যে এই অনুষ্ঠান প্রচলিত যে ছিল তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
যাঁরা বলছেন চড়ক আসলে ধনী কর্তৃক দরিদ্রদের উৎপীড়নের কাহিনি, উত্তর হিসাবে পল্লব সেনগুপ্তের “পূজা পার্বণের উৎসকথা” গ্রন্থ থেকে বলি, “উৎসবটির মধ্যে একটি সামাজিকভাবে বাঞ্ছনীয় দিক আছে। বছরের অন্ততঃ একটি দিন তথাকথিত ‘অন’-জাতের হতভাগ্য মানুষগুলি ‘ভদ্দর’ ও ‘শুদ্দুর’-দের সমকক্ষ বলে স্বীকৃত হয়”। উৎসবটির আচরণ সম্পর্কে ডঃ দুলাল চোধুরী বলেছেন, “এই সমস্ত প্রথা বছরের পর বছর পালন করেন যে-সব সাময়িক সন্ন্যাসীরা , তাঁরা বস্তুতপক্ষে অর্ধভুক্ত, শ্রমজীবি শ্রেণির মানুষ হলেও, বেশ কিছু গরীবী ব্যধির থেকে মুক্ত থাকেনঃ যথা হাঁপানী, যক্ষা ইত্যাতি। ভক্তরা একে শিবের মহিমা বলে গণ্য করলেও চৌধুরী এগুলিকে একধরনের রোগ নিবারক প্রক্রিয়া হিসেবেই গণ্য করেন, যা নাকি স্মরণাতীত কাল থেকে চালু রয়েছে” (পূজা পার্বণের উৎসকথা)
এই পূজা এবং এই পূজার আচরণ নিয়ে “হিন্দুর আচার- অনুষ্ঠান” গ্রন্থে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী “চড়কপূজা” নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, “বস্তুত এই পূজা ও ইহার অঙ্গীভূত উদ্দাম উৎসব এবং বাণ-বঁড়শি ফোঁড়া প্রভৃতি বীভৎস অনুষ্ঠান প্রাচীন পাশুপতদিগের কোনো সম্প্রদায় বিশেষের সহিত সংযুক্ত থাকা অসম্ভব নহে”। তিনি আরও লেখেন শঙ্করাচার্যের ভাষ্যে, নানা জৈন গ্রন্থে এদের সমালোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এই আচরণগুলি এই সময়েও প্রচলিত ছিল। ফলে নিছক হাল আমলের শাস্তির বিধান বলে দাগিয়ে দেওয়ার আগে অনেক বিবেচনার প্রয়োজন ছিল।
এবার আসা যাক, কেনো এই নিজেকে নির্যাতন সেই প্রসঙ্গে। ধর্মকে গুরুত্বহীন বলে দাগিয়ে দেওয়া হাল আমলের ফ্যাশন। কিন্তু প্রাচীন যুগ থেকে তাকালে দেখা যায় একটা সমাজ তার সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প সবকিছুকেই ধারণ করে আছে ধর্ম। বাঙালি চার হাজার বছরের পুরনো জাতি। আলেকজান্ডার গঙ্গারিডাইকে আক্রমণ না করে ফিরে যায় কারণ এখানকার সেনা বাহিনিকে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। আজকের সেনাবাহিনির দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাদের প্রতি পদে পদে কষ্ট সহ্য করার ট্রেনিং দেওয়া হয় না? হতেই পারেই ধর্মের আধারে এটাও একটা ট্রেনিং-এর মতই সে সময়কার অস্ত্র আর এই অনুষ্ঠানের শলাকা কোথাও এক মনে হচ্ছে না? তার সঙ্গে আরও একমাসের সন্ন্যাসকে ধরুন আর যুদ্ধক্ষেত্রে অল্পের মধ্যে মানিয়ে নেওয়া কিংবা স্ত্রীর থেকে, পরিবার থেকে আলাদা থাকা, মাটিতে শয়ন করা সবই হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখার প্রয়াস। আর এগুলো এখনও বেঁচে আছে বলেই আমাদের পূর্বমানুষ কেমন ছিলেন তা জানতে পারি। নিজেদের শিকড়কে খুঁজে পাই। কিছু বাঙালি বড়ই শিকড় বিস্মৃত জাতি তাই বারবার তার দাম দিতে হয় বাকি বাঙালিকে, বারবার হতে হয় ছিন্নমূল।
More Text Source: https://m.dailyhunt.in/news/india/bangla/presscard+news-epaper-pressc/jenenin+chadak+pujar+ajana+itihas+samparke-newsid-112036493?listname=topicsList&index=0&topicIndex=0&mode=pwa
Comments
Post a Comment