JishnuHari Mandir, Tamluk, Paschim Medinipur

 









জিষ্ণু-হরি মন্দির, পদুমবসান, তমলুক

" তমোলিপ্তাৎ পরং স্থানং নাস্মাকং প্রীতিরিষ্যতে "-- প্রীতি প্রদান করতে পারে, তমোলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত বা তমলুক) ছাড়া এমন স্থান নাই। একবার শ্রীকৃষ্ণ নাকি অর্জুনকে একথা বলেছিলেন। আর ঘটনা এমনই, একবার সেই তমলুক নগরীতে আসতেও হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণকে। 
সম্রাট অশোক আসবার বহু পূর্বেও খ্যাতি ছিল তাম্রলিপ্ত বা তমলুকের। মহাভারতের কাহিনীতে কয়েকবার এই নগরীর উল্লেখ দেখা যায়। আমরা ৩টি উল্লেখ করি এখানে-- ১. আদিপর্বে দেখা যায়, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভা আয়োজিত হয়েছিল পাঞ্চালদেশের রাজধানী কাম্পিল্য নগরে। তাম্রলিপ্তের রাজাও উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। ২. সভাপর্ব থেকে জানা যায়, রাজসূয় মহাযজ্ঞের সময়, ভারতবর্ষের প্রত্যেক রাজাকে " সুশিক্ষিত পর্বতপ্রতীম কবচাবৃত সহস্র কুঞ্জর (হাতি) প্রদানপূর্বক দ্বারে প্রবিষ্ট " হতে হয়েছিল। বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, সপুণ্ড্রক প্রমুখদের সাথে তাম্রলিপ্তের রাজাও সভায় উপস্থিত ছিলেন। ৩. ঐ সভাপর্ব থেকে আরও জানা যায়, দেশের অন্যান্য রাজন্যবর্গের সাথে, সুসজ্জিত অশ্ব এবং হস্তীবাহিনী সহ তাম্রলিপ্তের রাজাও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন।
কেবল অশ্বমেধ যজ্ঞ নিয়েই স্বতন্ত্র একটি পর্ব আছে মহাভারতে-- ' অশ্বমেধপর্ব'। সেকালে ভুবনবিখ্যাত রাজাগণ রাজসূয় যজ্ঞ করে, নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করতেন। তবে, তার পূর্বে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করতে হাত তাঁদের। প্রথমে ৯৯টি যজ্ঞের পর, শততম যজ্ঞের পূর্বে, একটি সুলক্ষণ অশ্বের কপালে 'জয়পত্র' বেঁধে, সৈন্য-সামন্ত সহ ভূ-পরিক্রমায় পাঠানো হত। অবাধগতি অশ্বটি এক বৎসরকাল স্বাধীনভাবে বিভিন্ন রাজ্য পরিক্রমা সেরে, ফিরে আসত যজ্ঞস্থলীতে। কিন্তু কোনও পরাক্রান্ত রাজা অশ্বকে আটক করলে, যুদ্ধ করে মুক্ত করে আনতে হত অশ্বটিকে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয়ের পর, অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন যুধিষ্ঠির। সেসময় তাম্রলিপ্তের রাজা ছিলেন পরম ধার্মিক, কৃষ্ণ-ভক্ত ময়ূৰধ্বজ। যজ্ঞের ঘোড়া তাম্রলিপ্ত পরিক্রমার সময়, রাজপুত্র তাম্ৰধ্বজ সেটিকে আটক করেন। অশ্ব উদ্ধারের জন্য, তৃতীয় পান্ডব অর্জুন এসেছিলেন তাম্রলিপ্তে। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সাথী হয়েছিলেন। বলা হয়, তাম্ৰধ্বজের পরাক্রমে মুগ্ধ হয়ে, অর্জুন তাঁর সাথে মিত্রতা করেছিলেন। অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণকে রাজপুরীতে নিয়ে গিয়েছিলেন তাম্ৰধ্বজ।
নিজের প্রাসাদেই অর্জুনের সাথে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে দেখে, আপ্লুত ময়ূৰধ্বজ আহ্লাদে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণকে তাম্রলিপ্তে থেকে যাওয়ার জন্য কাতর অনুনয় করতে থাকেন। তখন শ্রীকৃষ্ণই তাঁদের দু'জনের দুটি মূর্তি গড়ে, আরাধনার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন রাজাকে। ময়ূৰধ্বজও সেই পরামর্শ শিরোধার্য করে নিয়ে মন্দির গড়ে, অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেদিন থেকে মন্দিরের নাম হয়-- জিষ্ণু-হরি মন্দির।
অভিধানে 'জিষ্ণু' শব্দের ৩টি অর্থ-- জয়কারী, জয়ী ও জয়শীল। অতি পরাক্রমী শত্রূকেও তিনি পরাজিত করতে পারতেন, সেকারণে অর্জুনের নাম হয়েছিল-- জিষ্ণু। আর, 'হরি' শব্দের অন্তত ২৪টি অর্থ পাওয়া যায়, যার একটি হল-- বিষ্ণু। তিনি জগতের পাপ হরণ করেন, তাই বিষ্ণুর অপর নাম-- হরি। আমাদের অনুমান, এই দুই অর্ধভেদেই দেবতা এবং মন্দিরের " জিষ্ণু-হরি " নামকরণ হয়ে থাকবে। তাম্রলিপ্ত বা তমলুক ছাড়া, ভারতের অন্য কোথাও  জিষ্ণু-হরি নামের মন্দির আছে কি না, আমাদের জানা নাই।
যাইহোক, অতীত ছেড়ে, বর্তমানে ফিরে আসি আমরা। বর্তমানে জিষ্ণু-হরি নামে যে দুটি বিগ্রহ মন্দিরে পূজিত হয়, সেগুলি কষ্টিপাথরে 'বাস-রিলিফ' রীতিতে খোদাই করা। দুটিই শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ধারী চতুর্ভুজ মূর্তি। দুটি ফলকেই মূর্তির দু'পাশে দুটি উড্ডীয়মান গন্ধর্ব। নীচে দুটি অপ্সরা। পুরাতাত্ত্বিকদের অভিমত, মূর্তি দুটি আনুমানিক একাদশ-দ্বাদশ শতকে সেন-যুগে নির্মিত বিষ্ণুমূর্তি। কোনও প্রাচীন মন্দির থেকে আনীত হয়ে, এখানে পূজিত হচ্ছেন। 
রাজবাড়ীর ভিতরে রাধামাধব-রাধারমণ-এর যুগল মন্দিরে রাজপরিবার নিজেরাই সেবাপূজা করে থাকেন। তাঁদের নির্মিত তমলুক নগরীর অন্যান্য মন্দিরগুলি সম্পত্তি সহ বিভিন্ন সেবাইতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে দেখা যায়, 'রক্ষিত' পদবীধারী পূজক মন্দিরে যুক্ত আছেন। আদিতে এঁদের আনা হয়েছিল ওডিশার ক্ষীরচোরা-গোপীনাথ থেকে। মন্দিরের সেবাপূজার অধিকার লাভ করে, নিজেদের কুলপদবী 'রক্ষিত' ত্যাগ করে, 'অধিকারী' পদবী গ্রহণ করেছিলেন পুরোহিতরা। বর্তমানে বিগত ৪০ বছর যাবৎ সেই বংশের জনৈক ফাল্গুনী অধিকারী মন্দিরের সেবাপূজার ধারাটি বজায় রেখে চলেছেন।   
ইটের তৈরি মন্দিরটি পশ্চিমমূখী করে নির্মিত হয়েছিল, পশ্চিমের রাজবাড়ী থেকেই রাজা যাতে নিত্য দেবদর্শন করতে পারেন। রাজা ময়ূরধ্বজ যে বিগ্রহ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেগুলি বহু পূর্বেই জলস্রোতের করল গ্রাসে কবেই রূপনারায়ণের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। পরে বর্তমান রাজবংশের হাতে একটি মন্দির নির্মিত হয়েছিল। সেই মন্দিরও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। 
বর্তমানে যে মন্দিরটি বিরাজিত আছে, শোনা যায়, কোনও এক গোপাঙ্গনা সেটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এটিও পশ্চিমমূখী করেই নির্মিত হয়েছে। সামনে ১৭ ফুট উঁচু এবং ১২ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের জগমোহন। পিছনে ৩০ ফুট উচুঁ আর ২০ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বিমান বা মূল মন্দির। এই দুইয়ের মাঝখানে সংক্ষিপ্ত একটি অন্তরাল। এই তিন অংশ নিয়ে শিখর-দেউল রীতিতে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। খিলান-রীতির চারটি দ্বারযুক্ত জগমোহনটি চালা রীতিতে নির্মিত। তবে সামনে পৃথক একটি নাটমন্দিরও আছে দেখা যায়।
বিমান বা মূল মন্দিরের বাঢ় এবং গন্ডী অংশ জুড়ে কলিঙ্গধারায় 'রথ বিভাজন' করা হয়েছে। একটি রাহাপাগ, চারটি অনর্থপগ এবং দুটি কনকপগ-- এই নিয়ে 'সপ্ত-রথ' বিন্যাস করা। এই বিমান অংশের পিষ্ঠ, পা-ভাগ, বন্ধন এবং বরণ্ড বেশ প্রকট,  দেওয়াল থেকে উদ্গত করে নির্মিত হয়েছে। দুটি সৌধেরই  শীর্ষক অংশে বেঁকি, আমলক, কলস এবং বিষ্ণু-চক্র স্থাপিত। বিমান এবং জগমোহনের ভিতরের ছাদ গড়া হয়েছে 'লহরা-পদ্ধতি'তে।
অলংকরণ কিছুই নাই মন্দিরে। কেবল উত্তর ও দক্ষিণের বরণ্ড অংশের নীচে ছোট আকারের দুটি টেরাকোটা ফলক দেখা যায় মাত্র। তার একটি ফলক 'ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ' মূর্তি। চোখে পড়বার মত একটি তুলসিমঞ্চ আছে মন্দিরের সামনে।



Comments

Popular posts from this blog

Ram Sita Coin from Akbar's Era

Jagannath Mandir, Mirgoda, Purba Medinipur

Manasa Mangal Kavya