Narmadeshwar Shiva Mandir, Chirimarsai, Paschim Medinipur





 










নর্মদেশ্বর শিব মন্দির

বাংলার পশ্চিমের অন্যতম প্রান্তিক জেলা মেদিনীপুর। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত মেদিনীপুর ছিল কলিঙ্গ রাজাদের অধিকারে। সেসময় বহু বনেদী পরিবার যেমন  ওডিশা থেকে বাংলায় এসেছে, বাংলা থেকে গিয়েছেও অনেকে। মেদিনীপুরের বহু সম্পন্ন পরিবার  বাংলা লাগোয়া বালেশ্বর জেলায়, বিশেষত সমুদ্র তীরের এলাকাগুলিতে গিয়ে, জমিজমার মালিকানা গড়ে তুলেছিলেন।    


মেদিনীপুর শহরের দক্ষিণ দিক ঘেঁষা এলাকা চিড়িমারসাই। সেখানে প্রাসাদের তূল্য পশ্চিমমুখী অট্টালিকা গড়েছিলেন রামগোবিন্দ নন্দী। সাথে করিন্থিয়াম রীতির বড় বড় থাম দিয়ে সাজানো দুর্গামন্ডপ। সামনে নন্দী-পুকুর নামের জলাশয়। বাঁধানো পাকার ঘাট তিনদিকে। পূর্বদিকের ঘাটের গায়ে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামগোবিন্দ। দেবতার নামকরণ হয়েছিল -- নর্মদেশ্বর শিব।

পরে পরে জমিদাররা আরও দুটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম অনুসরণ করে, শৈব ও শাক্ত রীতির পাশাপাশি, বৈষ্ণবীয় রীতিতেও দেবসেবার সূচনা হয়েছে নন্দীবাড়িতে। অট্টালিকার ভিতরেই একটি দালান-মন্দির গড়ে, রাধামাধব নামে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মন্দিরের সাথে একটি অলংকৃত রাসমঞ্চও গড়া হয়েছিল সেসময়।   

কৃষ্ণমন্দিরটি দালান-রীতির হলেও, তিনটি শিবমন্দিরই 'শিখর-দেউল' রীতিতে গড়া হয়েছিল। তবে, খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে, কেবলমাত্র ' বিমান ' সৌধটিই গড়া হয়েছে। সামনের জগমোহন, ভোগমন্ডপ, বা নাটমন্দির অংশগুলি অনুপস্থিত।
এখনও আড়াই ফুট মত উচ্চতা আছে নর্মদেশ্বর শিব মন্দিরের পাদপীঠ অংশের। তার উপর পরিক্রমার জন্য প্রদক্ষিণ-পথ। তা থেকেই সরাসরি গর্ভগৃহে প্রবেশের একটি দ্বারপথ, খিলান-রীতির। গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে বড় আকারের চারটি পাশ-খিলানের মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে।
শিখর-দেউলের বিশিষ্টতা  হোল, মন্দিরের বাইরের দেওয়াল জুড়ে ' রথ-বিভাজন ' করা হয়। এখানেও তা অনুসরণ করা হয়েছে। পাদপীঠের উপর থেকে বাঢ়, বরন্ড এবং গন্ডী তিনটি অংশ জুড়ে সপ্ত-রথ বিন্যাস করা হয়েছে। শীর্ষক অংশে পর পর বেঁকি, আমলক, কলস এবং ত্রিশূল-দন্ড স্থাপিত আছে।  
নন্দীবাড়ির উৎকৃষ্ট স্থাপত্য হোল, কুলদেবতা রাধামাধবের নব-রত্ন রাসমঞ্চটি। ৩ ফুটের বেশি উঁচু পাদপীঠ। তাতে প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ। রত্ন বা চূড়াগুলি 'বেহারী রসুনচূড়া ' রীতির।
ভারি অলংকৃত মঞ্চটি। ৮টি দ্বারপথেরই দু'দিকে দুটি করে বাদিকা-মূর্তি। এছাড়াও, দ্বারপথগুলির দুই প্রান্তে দুটি খাড়া সারিতে এবং খিলানের মাথায় ভূমির সমান্তরাল একটি সারিতে-- মোট ১৫টি করে ছোট ছোট খোপ-- তাতে টেরাকোটা ফলক লাগানো।
ফলকের মোটিফ হিসাবে বিষ্ণুর দশাবতার, ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ, ভাঙ প্রস্তুতরত সন্ন্যাসী, বকাসুর বধ, মাতৃকোলে দুগ্ধ পানরত শিশু, তাড়কা রাক্ষসী বধ, কৃষ্ণের গোবর্ধন গিরি ধারণ, ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ ইত্যাদি বিষয় দেখা যায়। এছাড়াও, উৎকৃষ্ট কিছু পঙ্খের কাজও করা হয়েছে রাসমঞ্চে। কিন্তু বারংবার রঙের প্রলেপে সেগুলি সৌন্দর্য ও উৎকর্ষতা-- দুইই হারিয়ে ফেলেছে। শিব মন্দিরে কোনও অলংকরণ নাই।
জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে গেলেও, বৈধ মালিকানার জলাশয়গুলির উপস্বত্ব থেকে সেবাপূজা বা মন্দির সংস্কারের কাজটি ধরে রাখা হচ্ছিল। কিন্তু জলাশয়গুলির বেআইনি জবরদখল, আর প্রশাসনের উদ্যোগহীনতায়, ভয়ানক শোচনীয় অবস্থা এখন। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়েছে রাসমঞ্চটি। অচিরেই এটিকে রক্ষার উদ্যোগ না নিলে, সকলের চোখের সামনেই শিল্পকর্মটি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যাবে। তখন আগামী প্রজন্ম বা সমাজ-ইতিহাস আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।

Comments

Popular posts from this blog

Ram Sita Coin from Akbar's Era

Jagannath Mandir, Mirgoda, Purba Medinipur

Manasa Mangal Kavya