RamSita Mandir, Keshpur, Paschim Medinipur

 








রামসীতা মন্দির, শ্যামচাঁদপুর, 

একশ' বছরের বেশি বয়স হয়েছে, এমন মন্দির এই শ্যামচাঁদপুর গ্রামে অনেকগুলিই। তারমধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। সেটি নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
মন্দিরের কথায় যাওয়ার আগে, গ্রামটির দিকে একবার তাকিয়ে নেওয়া যেতে পারে। উল্লেখ করবার মত অনেকগুলিই বৈশিষ্ট আছে এই গ্রামের। কয়েকটির কথা বলি এখানে--
১. শ্যামচাঁদপুর থেকে অদূরে আড়রাগড় নামে এক গ্রাম। ব্রাহ্মণভূম পরগণার জমিদার বাঁকুড়া রায়ের রাজধানি ছিল আড়রাগড়ে। ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যাচারে, বর্ধমানের দামিন্যা গ্রামের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে এসে, বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ে উঠেছিলেন কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায়ের শাসনকালে চন্ডীমঙ্গল রচনা করে, "কবিকঙ্কণ " উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন মুকুন্দরাম। সেসময় জমিদারের আরাধ্য দেবী জয়চন্ডীর মন্দির আর লাগোয়া শ্যামচাঁদপুর গ্রামে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন কবি।  
২. এক সময় নারকীয় সতীদাহ প্রথা সাড়ম্বরে প্রচলিত ছিল শ্যামচাঁদপুর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায়। ছোট আকারের একটি সতী-মন্দির এখনও দেখা যায় শ্যামচাঁদপুর গ্রামে। রাজা রামমোহন রায় স্বয়ং এই গ্রামে এসে বৈঠক করেছিলেন। নিবারণ করেছিলেন এই প্রথাকে। সেই মহামনীষীর পদধূলি স্পর্শে ধন্য হয়েছিল শ্যামচাঁদপুর গ্রাম।
৩. শ্যামচাঁদপুর গ্রামের ঐতিহ্যের সাথে আর যে উজ্বল চরিত্রটির নাম জড়িয়ে আছে, তিনি হলেন অমর কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর শ্বশুরবাড়ী ছিল এই গ্রাম। রেঙ্গুনে প্লেগরোগে প্রথম স্ত্রী এবং শিশুপুত্রের মৃত্যুর পর, সেখানেই জনৈক কৃষ্ণদাস চক্রবর্তীর কন্যা হিরণ্ময়ী (ওরফে মোক্ষদা) দেবীকে বিবাহ করেছিলেন শরৎচন্দ্র। বিবাহের পরেই কৃষ্ণদাস স্বদেশে শ্যামচাঁদপুরে ফিরে এসে বসবাস করতেন। রেঙ্গুন ছেড়ে, বাংলায় ফিরে এলেও, শরৎচন্দ্র নিজে কখনও আসেননি এই গ্রামে। তবে নিয়মিত মানিঅর্ডার যোগে মাসোহারা পাঠাতেন শ্বশুরকে। হিরন্ময় দেবীকে পাঠাতেন শ্যামচাঁদপুর গ্রামে পিতার কাছে। কৃষ্ণদাসের বাস্তুভিটাটি এখনও দেখা যায় এই গ্রামে এলে।
৪. আট-আটটি প্রাচীন মন্দির আছে শ্যামচাঁদপুর গ্রামে। চারটি মন্দির গড়ে উঠেছিল ' রামানুজ সম্প্রদায় ' নামের একটি বৈষ্ণব গোষ্ঠীর মোহন্তদের হাতে। অস্তল নামে পরিচিত ছিল তাঁদের মন্দিরস্থলীটি। পঞ্চরত্ন এবং নবরত্ন রীতির দুটি শিবমন্দিরও আছে এই গ্রামে। ইংরেজ সরকারের এক বাঙালী হিন্দু দারোগা গড়েছিলেন শেষ দুটি মন্দির। তারই একটি মন্দির এই নিবন্ধের আলোচ্য।
৫. সেই দারোগা নিত্যানন্দ সিংহের মন্দির নির্মাণের পটভূমিকাটি দেখে নেওয়া যেতে পারে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলন করেন বড়লাট কর্ণওয়ালিশ। তার অভিঘাতে কেবল বাংলার প্রাচীন জমিদারী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়নি, রাজা-জমিদারদের হাজার হাজার পাইক-লেঠেল সৈন্য জীবিকাচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গীর জমি ভোগ করত সৈন্যরা। চাকুরিচ্যুত হয়ে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল সৈন্যরা। ইতিহাসে সেই বিদ্রোহ "চুয়াড় বিদ্রোহ" নামে পরিচিত হয়েছে।
এই বিদ্রোহ তীব্র হয়েছিল কর্ণগড়ের রানী শিরোমণি দেবীর পরামর্শ ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং গোবর্ধন দিকপতি নামক এক বিদ্রোহী নায়কের নেতৃত্বে। এইচ. ভি. বেইলি-র মেমোরেন্ডাম অব মিডনাপুর, নরেন্দ্র নাথ দাস-এর হিস্টোরি অব মেদিনীপুর ইত্যাদি গ্রন্থে, এই বিদ্রোহের বিশদ বিবরণ বর্ণিত আছে। মেদিনীপুর ফোর্টের কমান্ডার মি. গ্রেগরি-র একটি পত্র থেকে জানা যায়, ১৭৯৮ সালে চুয়াড় বিদ্রোহের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে, নিত্যানন্দ সিংহ নামের এক পুলিশ কর্তাকে বিদ্রোহ দমনে পাঠান হয়েছিল। নৃশংস এই দারোগা শত শত বিদ্রোহীকে হত্যা করে, বিদ্রোহ যেমন দমন করেছিলেন, শ্যামচাঁদপুর সহ কতকগুলি মৌজা দখল করে সেখানেই বসবাস শুরু করেছিলেন।
শ্যামচাঁদপুরে বসবাসকালে নিত্যানন্দের একমাত্র পুত্রের মৃত্যু হয়। শোকবিহ্বল নিত্যানন্দ গুরুর আদেশে, রামচন্দ্র-সীতাদেবী এবং লক্ষণ-এর বিগ্রহ স্থাপন করে, একটি মন্দির এবং রাসমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। সেবাপূজার ভার তুলে দেন মোহান্তদের হাতে।
বহুকাল হোল, রামানুজ সম্প্রদায় গ্রাম থেকে উঠে গিয়েছে। দেবতার সেবাপূজা এবং মন্দিরের দেখভাল গ্রামবাসীগণ করে থাকেন। নিত্যপূজা, রথযাত্রা, ঝুলন বা রাস উৎসব ইত্যাদি সকলই আড়ম্বরের সাথে আয়োজিত হয়ে থাকে এখানে।  
পঞ্চরত্ন বা নবরত্ন রীতির দেবমন্দির, মোহান্তদের শিখর বা চালা রীতির কয়েকটি সমাধি মন্দির আছে এখানে। কিন্তু রামসীতার মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে দালান-রীতিতে। ইটের তৈরী চওড়া দেওয়ালের পূর্বমুখী সৌধ। সামনের অলিন্দে প্রবেশের জন্য গোলাকার থাম এবং খিলান-রীতির পাঁচটি দ্বারপথ। ভিতরের ছাদ বা সিলিং খিলান রীতিরই। কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে। 
রাসমঞ্চটি বেশ উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত। 'বেহারী রসুন' রীতির ন'টি চূড়া বিশিষ্ট। তবে দ্বারপথ চারটি। বাকি চারটি 'প্রতিকৃতি দ্বার'। প্রত্যেকটিতে একটি করে দ্বারপাল মূর্তি রচিত হয়েছে। এছাড়া, খিলানের নীচ বরাবর সারি সারি কপোত এবং দ্বারপথগুলির দুই প্রান্তে খাড়া সারিতে কিছু মূর্তি দেখা যায়। তবে, সবই সাধারণ মানের। 
তেমন কোনও স্থাপত্য বৈশিষ্ট নাই এই মন্দিরের। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রথ গণ-বিদ্রোহের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই মন্দির। 

Comments

Popular posts from this blog

Dandesvara and Mahamaya Mandir, Karnagarh, West Medinipur

Manasa Mangal Kavya

Jagaddala Mahavihara