Sitaram Mandir, Ghatal, Paschim Medinipur

 








সীতারাম মন্দির, খড়ার-উদয়গঞ্জ, ঘাটাল

মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পূর্ব এলাকার এক সমৃদ্ধ জনপদ খড়ার। এর সমৃদ্ধি আর খ্যাতি নির্মিত হয়েছিল মুখ্যত কাঁসাশিল্পের কারণে। অর্থনৈতিক বিকাশ শুরু হলে, এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল স্বর্ণবণিকেরাও। এই দুই হস্তশিল্পের সুবাদে, বহু ধনাঢ্য পরিবারের উদ্ভব হয়েছিল খড়ারে। তাঁদের হাতে বিশাল বিশাল অট্টালিকা, বহুসংখ্যক দেবালয়ও নির্মিত হয়েছিল। তার অনেকগুলোই আজ আর টিকে নাই। যেগুলি আছে, তাদের ইতিহাসও জানা নাই সকলের। ধূলিমলিন সেই ইতিহাসের কয়েকটি পাতা উল্টে দেখব আমরা। খড়ার নগরীর আকারে সবচেয়ে বড়, এবং একমাত্র ত্রয়োদশ-রত্ন মন্দিরটি হলো এই সীতারাম মন্দির। 

একসময় কাঁসাশিল্পে বেশ বড় মাপের একজন উৎপাদক এবং ব্যবসায়ী ছিলেন জনৈক ব্রজলাল মাজী। খড়ারের উদয়গঞ্জ মহল্লার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। খড়ার বা ঘাটাল শহরে দোকান তো ছিলই, সারা জেলাতে তাঁর বাসনের কদর ছিল। কদর ছিল লাগোয়া বাঁকুড়া, বর্ধমান আর হুগলি জেলাতেও। 

এমনকি, কলকাতার বাজারেও মাল রপ্তানী করতেন ব্রজলাল। গরু-মোষের পিঠে ছালা করে, বা গাড়িতে চাপিয়ে ঘাটালের কুঠিঘাটে মাল নিয়ে যেতেন। সেখান থেকে ভাউলে নৌকা বা স্টিমারযোগে রূপনারায়ণ আর হুগলি নদীর বুক বেয়ে কলকাতার বাজারে।

কাঁসার ব্যবসা থেকে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন ব্রজলাল। বিশাল আকারের অট্টালিকা বানিয়েছিলেন বসবাসের জন্য। একটি দূর্গা দালানও গড়েছিলেন সেই সাথে। তারই লাগোয়া করে বানিয়েছিলেন একটি 'ঠাকুরবাড়ি'-- পাশাপাশি দুটি শিবমন্দির এবং কুলদেবতার জন্য একটি বিষ্ণুমন্দির বানিয়েছিলেন সেখানে। 'রঘুনাথ' নামের একটি শালগ্রাম শিলা 'সীতারাম' নামে পূজিত হয় মন্দিরে। খড়ারকে মন্দির-নগরী বলা যায় নির্দ্বিধায়। পাড়ায়-পাড়ায় অলিতে-গলিতে মন্দির এই নগরীতে। ব্রজলালের নির্মিত এই মন্দিরটি সেগুলির ভিতর বিশালতম, আর শ্রেষ্ঠতমও। 

মন্দিরটি আকারে বিশাল-- দের্ঘ্য আর প্রস্থে সাড়ে ১৫ ফুট, মাথার উচ্চতা ৫৫ ফুট। শ্রেষ্ঠতম বলা হল একারণে যে, আরও কয়েকটি রত্নমন্দির থাকলেও, তেরো-চূড়া মন্দির খড়ার নগরীতে মাত্র এই একটিই। চার দিকেই তিন-খিলানের দ্বারযুক্ত অলিন্দ আর গর্ভগৃহ নিয়ে এই মন্দির-- ইটের তৈরী, পূর্বমুখী। দ্বিতলেও চার দিকেই অলিন্দ রচিত হয়েছে, তিনটি করে দ্বারপথ সহ। তৃতীয় তলে অলিন্দ নাই, তবে চার দিকের দেওয়ালে ভিনিশীয় রীতির প্রতিকৃতি-দ্বারপথ রচনা করা হয়েছে। 

ন'টি রত্নেই রথভাগ এবং পীঢ়-রীতির প্রয়োগ করা হয়েছে, দেখা যায়। প্রতিটিরই বেঁকি, আমলক, কলস এবং বিষ্ণুচক্রে সাজানো। 

গর্ভগৃহের দ্বারপথের দুদিকে দুটি দ্বারপাল মূর্তি, সেগুলি সাহেবি পোশাক পরিহিত। পিছনের দেওয়ালে আধখোলা ভিনিশীয়-রীতির দরজার প্রান্তে দাঁড়ানো একটি দ্বারবর্তিনী মূর্তি আছে। এছাড়া, টেরাকোটা ফলকে অলংকরণ করা হয়েছে সামনের প্রথম কার্ণিশের নীচে এক সারি এবং দুদিকের দেওয়ালের কোনাচ অংশে দুটি খাড়া সারিতে। 

মন্দিরের একটি প্রতিষ্ঠালিপি থেকে জানা যায়, ১৭৮৬ শকাব্দ বা ইং ১৮৬৪ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। 

বিগত দেড়শ' বছরেরও বেশি সময়কালে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে শিলাবতী আর রূপনারায়ণের বুক বেয়ে। রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক বিবর্তনও হয়েছে অনেক। দেবতার সামান্য কিছু সম্পত্তি ছাড়া, হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বাকি সবই। ফলে, দেবতার সেবাপূজায় পূর্বের আড়ম্বর আর নাই এখন। তবু নিত্যপূজা হয় দু'বেলা। বছরের বিশেষ তিথি আর পার্বণগুলিও পালিত হয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেই। জন্মাষ্টমী, রাসপূর্ণিমা, নবান্ন, মকর আর শয়ন একাদশী। শয়ন একাদশীতে সদ্য কেটে আনা দুটি আখ মন্দিরের চুড়ায় বেঁধে, 'কোচপালো' নামের অনুষ্ঠানটি বেশ চিত্তাকর্ষক। 

বৈষ্ণবীয় রীতির এইসব অনুষ্ঠান ছাড়াও, দূর্গা, কালী এবং লক্ষ্মী পূজাতেও ভক্তজনের ভিড় হয়ে এই মন্দিরে।

মন্দিরের দেবতার সেবাপূজার ধারাটিকে কোনমতে বাঁচিয়ে রেখেছে সেবাইত মাজী পরিবার। কিন্তু কোরিন্থিয়াম থামের এই বিশাল প্রাসাদ আজ ভারী জীর্ণ। বিশেষত, মন্দিরটিকে কালের আঘাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা তাঁদের সাধ্যের অতীত।

পুরাতাত্ত্বিক এই ঐতিহ্যটিকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে, এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরই। দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদকে রক্ষা করবার দায়িত্ব সকল সচেতন নাগরিকেরই।

Comments

Popular posts from this blog

Dandesvara and Mahamaya Mandir, Karnagarh, West Medinipur

Manasa Mangal Kavya

Jagaddala Mahavihara