Devi Petkati(Charchika), Jalpaiguri

 





'পেটকাটি মা' দেবী চর্চিকা : পালযুগ 


দেবীর বর্তমান নাম পেটকাটি মা। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির কাছে যে গ্রামে তাঁর মন্দির আছে সেই স্থান এখন পেটকাটি নামে পরিচিত। ১৯৩৫-৪০ সালে ঐ গ্রামে একটি প্রাচীন পুকুর খননের কাজ চলছিল। প্রায় দশ বারো ফুট খননের পর এই দেবীমূর্তি পাওয়া যায়। মূর্তিটি কষ্টিপাথরের; প্রায় সাড়ে তিন ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। করালবদনী শীর্ণকায়া মুণ্ডমালিনী এই দেবীর বারোটি হাত। আর বিশেষত্ব হল অতি শীর্ণ উদরে একটি বৃশ্চিক বা বিছে আঁকা রয়েছে। মূর্তিটি দশম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর পাল সেন যুগের ভাস্কর্য বলেই মনে হয়। সৌভাগ্যের বিষয় হল মূর্তিটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থাতেই উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে ঐখানে একটি মন্দির নির্মাণ করে সেখানেই দেবীকে কালী রূপে পূজা করা হয়। 

উত্তরবঙ্গের প্রাচীন করতোয়া নদীর উত্তরে সমগ্র ভূখণ্ডই প্রাচীনকালে পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত ছিল। বাণগড় ও মহাস্থানগড় সেই পুণ্ড্রেরই দুই প্রধান নগর ছিল। মহাস্থানগড়ই ছিল পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুণ্ড্রনগর(পুন্দলগর)। 

জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি সন্নিহিত এই পেটকাটি দেবীর মন্দিরটিও প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনেরই অন্তর্গত ছিল। 

নীহাররঞ্জন মহাশয় এবং আরো অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রাক মৌর্য যুগ থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত এখানে সুসংবদ্ধ নাগরিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন করে জলপাইগুড়ি অঞ্চলের চিল্লা রাজার গড়কে পুণ্ড্রেরই অন্তর্গত বলে সিদ্ধান্ত করেছিলেন। 

এই পেটকাটি দেবীর মূর্তির বর্ণনা অনুযায়ী: দেবী দ্বাদশভুজা, ভীষণা, অস্থিচর্মসারা, করালবদনী। উদরে বৃশ্চিকচিহ্ন আছে। শীর্ণকায়া ভীষণা এই দেবীকে স্থানীয় অনেকেই দশমহাবিদ্যার অন্তর্গত দেবী ধূমাবতী বলে মনে করেছেন। মন্দিরটিও ধূমাবতী চণ্ডীমাতার মন্দির বলে চিহ্নিত। কিন্তু এই ধারণা ভুল। দেবীমূর্তির বিবরণ দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায় এই বিগ্রহ পালযুগে পূজিতা দেবী চামুণ্ডা বা চর্চিকার। ইনিই রূপভেদে বজ্রযানে অক্ষোভ্য বুদ্ধমণ্ডলে বজ্রচর্চিকা রূপে পূজিতা হতেন। সাধনমালা ও গুহ্যসমাজতন্ত্রে তাঁর সাধনপদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। 

রূপভেদে এই দেবী কখনও দ্বিভুজা, কখনও চতুর্ভুজা, কখনও ষড়ভুজা, কখনও দ্বাদশভুজা। উড়িষ্যার চৌষট্টি যোগিনী ও চামুণ্ডা মন্দির থেকে রাজশাহী পর্যন্ত সমগ্র বৃহৎ বঙ্গেই তাঁর উপাসনা হত পালযুগে। নয়পালদেবের সময়ে শ্রীধর নামে একজন বাঙালি কবি এই চর্চিকা প্রশস্তি রচনা করেন। সময়কাল একাদশ শতক। প্রসঙ্গত নয়পালের বাণগড় প্রশস্তি শুরুই হয়েছে ওঁ নমশ্চর্চ্চিকায়ৈ বলে। 


ওঁ নমশ্চর্চ্চিকায়ৈ।। 


সুরাসুর শির:শ্রেণী পটবাস সমা জগৎ। 


পান্তু বিশ্বকৃতাভ‍্যর্চ্চর্চ্চাশ্চর্চ্চাচরণরেণব। 


দ্রংষ্টা সন্ধি নিলীনমেক কবলম্বি লং বিশ্বন্তদশ্নামি কিং। 


সপ্তাম্ভোধি জলানি হস্ত সুষি রে গুপ্তানি কিং পীয়তে। 


ইত্যাহার দরিদ্রতাকুলতয়া শুষ‍্যত্তনুম্বিভ্রতী 


কল্পান্তে নৃকপালমণ্ডন বিধিঃ পায়াজ্জগচ্চর্চ্চিকা। 


সদুক্তিকর্ণামৃতে আমরা দেখি সেনরাজসভার কবি উমাপতিধর, শতানন্দ নামের এক কবি এবং জনৈক অজ্ঞাতনামা কবি চর্চিকার স্তব রচনা করেছেন। শত্রুর রক্তপানকারিনী, ক্ষুধাতুরা শীর্ণদেহা মুণ্ডমালিনী এই দেবী দৈত্যগণের রক্তে চর্চিতা বলেই চর্চিকা নামে অভিহিত হয়েছেন উমাপতিধরের স্তবে।

"দ্রংষ্ট্রাকোটিতটোৎপত্তিষ্ণুদিতিজাসৃকচর্চিতাম্ চর্চিকাম।।"

অর্থাত্ পালযুগ থেকে সেনযুগে এই চর্চিকা উপাসনার একটি নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য ছিল এবং একদিকে যেমন বজ্রযানী সাধকগণ মণ্ডলে তন্ত্রমতে এঁর বন্দনা করতেন; অন্যদিকে তেমনি বাঙালির যোদ্ধারা এবং রাজন্যবর্গ শত্রুবিজয়ের উদ্দেশ্যে এনার উপাসনা করতেন। 

নীহাররঞ্জন মহাশয় এই চর্চিকা বা চামুণ্ডা দেবীর আরো কয়েকটি রূপভেদেরও উল্লেখ করেছেন। যথা সিদ্ধচামুণ্ডা, রুদ্রচামুণ্ডা, রুদ্রচর্চিকা। চণ্ডীতে চণ্ডমুণ্ডবধ প্রসঙ্গে কালীর যে বিবরণ পাই তা হুবহু এই চামুণ্ডার অনুরূপ।

বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা

দ্বিপিচর্মপরিধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা

অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা

নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্মুখা

( দেবী বিচিত্র খট্বাঙ্গ ধারিণী, মুণ্ডমালিনী, ব্যাঘ্রচর্মপরিহিতি, শীর্ণদেহা, অতি ভয়ঙ্করী। বিস্তৃত মুখগহ্বরে রক্তবর্ণ জিহ্বা মনে ভীতির সঞ্চার করে। কোটরগত রক্তচক্ষুযুক্তা দেবী ভীষণ নাদে চারিদিক পূর্ণ করে রেখেছেন।)

এই বিষয়ে শশীভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় আলোকপাত করেছেন। 

প্রসঙ্গতঃ নীহাররঞ্জন মহাশয়ের মতে উত্তরবঙ্গে দেবপালের সময় থেকে কম্বোজ পালবংশের রাজত্ব ছিল। সম্ভবত দেবপাল যখন পালসাম্রাজ্য হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত করেন তখনই এই পার্বত্য কম্বোজবংশ পালবংশের সংস্পর্শে আসে। ইর্দা তাম্রশাসন অনুযায়ী পালসাম্রাজ্যের দুর্বলতার সময়ে এঁরা স্বাধীন রাজবংশ রূপে রাজত্ব করেছিলেন এবং প্রিয়ঙ্গু নামক স্থানে এঁদের রাজধানী ছিল। মহীপাল ও নয়পালের সময়ে এঁরা বোধহয় পুনরায় পালসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হন। তবে একথা অনস্বীকার্য যে এঁরা পালবংশ ও তৎকালীন বাঙালির সাথে একই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করতেন। সেক্ষেত্রে এই পেটকাটি চর্চিকা দেবীর প্রতিষ্ঠা ও উপাসনা তাঁদের মাধ্যমে হওয়াই সম্ভব। 

যেভাবে পুকুরের অনেক গভীরে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় এই মূর্তি পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যায় তুর্কি আক্রমণের সময় এই মূর্তিকে এই স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। মিনহাজের বিবরণ থেকে জানা যায় তিব্বত অভিযানকালে বখতিয়ার উত্তরবঙ্গে আক্রমণ করেছিল এবং পুণ্ড্রের দেবীকোট ছিল তার সামরিক রাজধানী। সম্ভবত সেই সময়েই এই মূর্তি এই পুকুরের গভীরে স্থান পায়। এবং যেহেতু অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে; সুতরাং বলাই যায় তুর্কি আক্রমণের বর্বরতা থেকে এই মূর্তি রক্ষা পেয়েছিল।

এইভাবে পালযুগের দেবী চর্চিকার মূর্তি দীর্ঘকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার পর আবার আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রশাসনের ঔদাসীন্যের কারণে এখনও যথোপযুক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় নি। প্রত্নচোরদের হাত থেকে এই অমূল্য সম্পদের রক্ষার বিষয়ে সকলেরই যত্নবান হওয়া উচিত। 


Comments

Popular posts from this blog

Dandesvara and Mahamaya Mandir, Karnagarh, West Medinipur

Manasa Mangal Kavya