Rameshwar Shiva Mandir, Nayagram, Paschim Medinipur

 








রামেশ্বর শিব মন্দির--  দেউলবাড় (নয়াগ্রাম)

দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ।  দীর্ঘ সাড়ে চারশ' বছর। মেদিনীপুর জেলার সিংহভাগ এলাকা অধিকার করে রেখেছিলেন কলিঙ্গের রাজারা। তার উপর, কলিঙ্গ রাজ্যের একেবারে গা-লাগোয়া অবস্থান এই জেলার। এই দুই কারণে, ওডিশার শিল্প আর সংস্কৃতির গভীর প্রভাব মেদিনীপুর জেলার উপর।

মন্দির স্থাপত্যে এই প্রভাব বেশ প্রকট। মেদিনীপুর জেলায় ' শিখর দেউল রীতি 'র যতগুলি মন্দির নির্মিত হয়েছে, সবই কলিঙ্গের প্রভাবে।

তবে, রীতিটিকে আদর্শভাবে অনুসরণ করা হয়েছে, এমন মন্দির মাত্র দুটি-- নয়াগ্রাম থানার দেউলবাড় গ্রামের এই মন্দির।  আর দ্বিতীয়টি হল ডেবরা থানার চন্ডিপুর গ্রামের কেদারেশ্বর  শিব মন্দির। দুটির ভেতর দেউলবাড়ের এই মন্দিরটিই সেরা।

মেদিনীপুর (বর্তমানে ঝাড়গ্রাম) জেলার নয়াগ্রাম থানায় মন্দিরটি অবস্থিত। সুবর্ণরেখার একেবারে পাড়ের উপর। কিংবদন্তি, লোকশ্রুতি আর ইতিহাস-- তিন উপাদান নিয়ে গড়ে উঠেছে এই মন্দিরের কাহিনী। কিংবদন্তিটি রামায়ণেরকাহিনী ভিত্তিক। বলা হয়, রামচন্দ্র সীতাদেবীকে নির্বাসন দিলে, তিনি এখানেই বাল্মীকির তপোবনে অবস্থান করতেন। মন্দির থেকে কয়েক কিমি দূরে ' তপোবন ' নামে একটি স্থানও আছে এখানে। সীতাদেবী অনুরোধ করলে, স্বয়ং ভগবানের আদেশে, বিশ্বকর্মা এই মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। দ্বাদশ-লিঙ্গ শিব প্রতিষ্ঠা করে মহাদেবের আরাধনা করতেন সীতাদেবী। স্বামী রামচন্দ্রের নামে নামকরণ করেছিলেন মহাদেবের-- রামেশ্বর নাথ শিব। 

আজও মন্দিরের গর্ভগৃহে দেখা যায়-- নিচু গম্ভীরায় এগারোটি শিবলিঙ্গের বেষ্টনী। তার কেন্দ্রে পদ্মাসনে উপবিষ্ট  একটি পাথরের বৃষভ মূর্তির উপর শিবলিঙ্গটি স্থাপিত। নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, লিঙ্গমূর্তির পিছন দিকে তিনটি জটা, লিঙ্গের গায়ে খোদাই করা। স্বয়ং দেব-কারিগর ছাড়া, কেই বা নির্মাণ করবে এমন বিশিষ্ট বিগ্রহ-- এমনই বিশ্বাস মানুষজনের। প্রকৃতই সারা জেলায় এমন শিবলিঙ্গ আর নাই।

লোকশ্রুতির কথায় আসে মারাঠা শক্তি বর্গীবাহিনীর প্রসঙ্গ। সুবর্ণরেখার দক্ষিণের এলাকা ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজার এলাকা। যা বর্গীদের দখলে চলে গিয়েছিল। গোপীবল্লভপুরে সেনাঘাঁটি ছিল বর্গীদের। আজও সেই জায়গা ' বর্গীডাঙ্গা ' নামে পরিচিত। বলা হয়, শৈবপন্থী মারাঠারা রামেশ্বর নাথের এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। উঁচু টিলার উপর মন্দিরটি স্থাপিত। দেবতার আরাধনা ছাড়াও, শত্রূপক্ষের উপর নজরদারিও করত তারা এখান থেকে।  

কিন্তু ইতিহাস বলে, নয়াগ্রামের চতুর্থ রাজা ছিলেন চন্দ্রকেতু সিংহ। তিনি একটি মন্দির নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য ভগবান রামচন্দ্রের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। মন্দির নির্মাণ করে তিনিই বিগ্রহের নাম করেছিলেন-- রামেশ্বর।

চিরপ্রবাহিনী সুবর্ণরেখা। তার দক্ষিণ তীরে একটি দমদমা (উঁচু টিলা)র উপর মন্দিরটি অবস্থিত । নদীর এপার ওপার চরাচর জুড়ে সবুজে মোড়া গ্রামের পর গ্রামের ছবি  চোখ জুড়িয়ে দেয়।  

সামনে পূর্বদিকে ৩০-৪০ ফুট নিচে আয়তাকার জলাশয়-- কুণ্ডপুকুর। নদীর উত্তরপাড়ে রোহিনীগড়। তার জমিদার লক্ষ্মীনারায়ণ ষড়ঙ্গী পাথরের ঘাট, আর মন্দির পর্যন্ত ৬৭ ধাপের সিঁড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। মন্দিরের চারপাশ জুড়ে বাগান গড়ে তুলেছে রাজ্যের সরকার। ঐতিহ্য আর সৌন্দর্য নিয়ে পর্যটনের মনোরম পরিবেশ এখানে। 

পাথরের তৈরী পূর্বমুখী রামেশ্বর মন্দিরে পর পর পাঁচটি সৌধ। সামনের দিক থেকে সেগুলি হল-- ভোগমন্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন, অন্তরাল এবং মূল মন্দির বা বিমান। ভোগমন্ডপ চতুর্দ্বারী, বর্গাকার। বাইরের ছাউনি তিন থাক পীঢ়া রীতির। এর পাদপীঠ অংশের তিন দিকে ' বা-রিলিফ ' রীতির ১৩টি করে 'প্রতিকৃতি দেউল' নির্মিত আছে। চতুর্দ্বারী নাটমন্দিরটি বাংলা দো-চালা রীতির।  পাঁচ থাক পীঢ়া রীতির জগমোহন সৌধ। অন্তরাল অংশটি রীতি অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত। বিমান সৌধের উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। বহু কাল ধরে এই বিমান সৌধটি কয়েক ডিগ্রী হেলে আছে।


দাক্ষিণাত্যের দুর্গ-মন্দির বা ফোর্ট-টেম্পল-এর আদলে গড়া হয়েছিল এটি। চারদিক জুড়ে উঁচু পাথরের প্রাচীর। ভিতরে সারি সারি কুঠুরী। যাত্রীনিবাস, সাধু-সন্তদের জন্য অতিথিশালা, রক্ষীদের ঘর, পাকশাল, গুদামঘর-- আরও কত কী। আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। কয়েকটি প্রাচীন স্তম্ভই টিকে আছে কেবল।

মন্দিরকে কেন্দ্র করে আরও কয়েকটি ইমারত ছিল। উত্তর আর পশ্চিম দিকে কিছু ভাঙা দেওয়াল, ইমারতের ধ্বংসস্তূপ সে কথাই জানান দেয়।

অলঙ্করণ হিসাবে কয়েকটি খোদাই করা মূর্তি আছে এই মন্দিরে। বিমানটি সপ্তরথ বিভাজন করা। তার চারদিকেই রাহাপাগের উপর চারটি লম্ফমান সিংহ-- কলিঙ্গ-স্থাপত্যের নিদর্শন এটি। জগমোহনের প্রবেশপথের দু'দিকে দুটি দ্বারপাল মূর্তি। নাটমন্দিরের দু'দিকের দেওয়ালে ষড়ানন (ছয়মুখ বিশিষ্ট) ময়ূরবাহন কার্তিক এবং মূষিক বাহন চতুর্মুখ গনেশ মূর্তি রচিত আছে।  

নিত্যদিন যাত্রী আনাগোণা চলে মন্দিরে। ফাল্গুনের শিবরাত্রি, চৈত্রে বারুণি স্নান আর সংক্রান্তিতে গাজন-- তিন বার মেলা বসে এখানে। টিলায় চড়ে, বন-বাদাড় মাড়িয়ে, নদীর বালি ভেঙেও মানুষ আসে কাতারে কাতারে। মেলার দিনগুলোতে ভীড় যেন একেবারে ভেঙে পড়ে মন্দিরে। পুণ্যার্থী ছাড়াও, পর্যটকের আনাগোনাও লেগেই আছে সারা বছর।


Comments

Popular posts from this blog

Ram Sita Coin from Akbar's Era

Jagannath Mandir, Mirgoda, Purba Medinipur

Manasa Mangal Kavya