Singhabahini Mandir, Shiromani, Paschim Medinipur

 




সিংহবাহিনী মন্দির, শিরোমণি (মেদিনীপুর সদর)

এখানে গ্রামটির নাম-- শিরোমণি। কিন্তু  শিরোমণি শব্দটি প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দেয় মেদিনীপুর জেলার এক রানির কথা। তিনি বিখ্যাত কর্ণগড় রাজ্যের আরও বিখ্যাত রানি শিরোমণি। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম গণবিদ্রোহ ছিল ' চুয়াড় বিদ্রোহ '। মেদিনীপুর জেলাতেই তার উদ্ভব ও বিস্তার। সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসের পাতায় যাঁর নাম লেখা হয়েছে, তিনি, কর্ণগড় রাজ্যের সর্বশেষ রাজা অজিত সিংহের কনিষ্ঠা পত্নী, রানি শিরোমণি।

আজ যে মন্দিরের সালতামামি এই নিবন্ধে, সেটি  শিরোমণি নামেরই এক গ্রামে অবস্থিত। গ্রামেরই এক অধিবাসী ছিলেন জনৈক বৈদ্যনাথ সরকার। নিজের কনিষ্ঠা কন্যাটির নাম রেখেছিলেন শিরোমণি। গ্রামের নাম থেকে কন্যার নাম রেখেছিলেন, না কি, পরে রানি হয়ে ওঠা সেই কন্যার নাম থেকে গ্রামের নাম শিরোমণি হয়েছিল, এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। আমরা বরং ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে নিই।

ইং ১৫৬৮ সাল। বলরামপুরের রাজা সুরথ সিংহকে হত্যা করে, তাঁর নিজেরই দেওয়ান লক্ষ্মণ সিংহ, মেদিনীপুর মহালে নিজের জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজধানী হয় কর্ণগড়। তখন থেকে এটি কর্ণগড় রাজ্য নামে পরিচিত হয়ে আসছে। 

এই রাজবংশের রাজত্বকাল মোটামুটি সওয়া দু'শ বছর। ১৫৬৮ থেকে ১৭৯৯ সালে রানি শিরোমণির গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত। প্রথম ১০০ বছরে লক্ষ্মণের  পর রাজা হয়েছেন শ্যাম সিংহ, পুরুষোত্তম সিংহ এবং সংগ্রাম সিংহ। পরের সওয়া একশ' বছরে ক্রমান্বয়ে ছোটু রায়, রঘুনাথ রায়, বীর সিংহ, রাম সিংহ, যশোবন্ত সিংহ, অজিত সিংহ এবং রানি শিরোমণি।  ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বিবাদের কারণে, নিজের কর্ণগড় রাজ্য নাড়াজোল রাজবংশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শিরোমণি।

এ প্রসঙ্গ থাক। আমরা মন্দিরের কথায় ফিরে যাই। কর্ণগড় রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন যশোবন্ত সিংহ। ১৭১১ থেকে ১৭৪৮ তাঁর রাজত্বকাল। এই রাজা যেমন সুশাসক ও সদাশয় ছিলেন, তেমনই ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান হিন্দুও। নিজের জমিদারি মহালের মধ্যে অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন তিনি। শিরোমণি গ্রামটি তাঁর রাজধানি কর্ণগড়ের অদূরেই। যশোবন্ত ছিলেন দেবী মহামায়ার সেবক। মন্দিরে সিংহবাহিনীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অষ্টধাতু নির্মিত চতুর্ভুজা মূর্তি, ছোট আকারের। সেটি চুরি যাওয়ায়, মৃন্ময় মূর্তিতে আরাধনা হয় দেবীর।

রত্ন-রীতির বহু মন্দির মেদিনীপুর জেলায় নির্মিত হয়েছে। তবে, তার ভিতর এক-রত্ন মন্দির সংখ্যায় বড় একটা বেশি নয়। হাতে গোণা কয়েকটি মাত্র। তারই একটি নিয়ে আজ আমাদের এই নিবন্ধ। 

এক-রত্ন মন্দিরের গর্ভগৃহটি দালান কিংবা চালা যে কোনও রীতির হতে পারে। তার মাথায় একটি মাত্র রত্ন স্থাপন করে এক-রত্ন মন্দির নির্মিত হয়। শিরোমণি গ্রামের এই মন্দির নির্মিত হয়েছে চালা-ছাউনির গর্ভগৃহকে আশ্রয় করে।

সম্পূর্ণ বর্গাকার সৌধ-- দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দুইই সাড়ে ১৯ ফুট, উচ্চতা ৪০ ফুট। লক্ষ্যণীয় বিষয় হোল, এই মন্দিরের গর্ভগৃহ অংশের চেয়ে উপরের রত্ন অংশটি বেশি উঁচু। সচরাচর এমনটি দেখা যায় না। ফলে, মন্দিরে বেশ একটি ঋজু ভঙ্গী সৃষ্টি হয়েছে।

দুটি অংশ মন্দিরের-- সামনে একটি অলিন্দ। খিলান রীতির তিনটি দ্বারপথ। স্তম্ভগুলি ইমারতি রীতির। অলিন্দের সিলিং হয়েছে টানা-খিলান করে। গর্ভগৃহের একটিই দ্বারপথ। সিলিং হয়েছে পরপর তিনটি বড় খিলানের মাথায় গম্বুজ নির্মাণ করে।

দ্বিতলে উঠবার সিঁড়ি আছে মন্দিরে। রত্নটির নির্মাণ হয়েছে শিখর-দেউল রীতিতে। বেদী সহ রত্নটি পঞ্চ-রথ বিভাজন করা। তবে, রত্নের গন্ডী অংশে পীঢ়া রীতির প্রয়োগ হয়নি। বাঢ় আর গন্ডীর বিভাজক বরণ্ড অংশটি বক্ররেখায় রচিত।

কিছুকাল পূর্বে, রত্নের শীর্ষক অংশটিতে সংস্কারের কাজ হয়েছে। বেঁকি, আমলক, কলস ও নিশান-দন্ড সংস্কৃত হয়েছে।

অলংকরণের দুটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। ছয়-ছয়টি দ্বারপাল মূর্তি আছে মন্দিরে। সবই স্টাকোর কাজ। দ্বিতীয় হোল-- উত্তর আর দক্ষিণের দেওয়ালের অলংকরণ। সারা দেওয়াল জুড়ে একটি করে ' প্রতিকৃতি প্রাসাদ ' রচিত হয়েছে সেখানে। দু'পাশে দুটি দ্বারপাল। মাঝে দ্বিতল প্রাসাদ, জাফরি কাটা দরজা  এই সব। জেলার অন্য কোথাও এমনটি দেখা যায়নি।

শেষ বিষয় একটি সুড়ঙ্গের চিহ্ন। মন্দিরের দ্বিতলে উঠবার সিঁড়িটি আছে অলিন্দের বাম কোণে। আর ডাইনে আছে একটি গহ্বর। শোনা যায়, এটি আদতে একটি সুড়ঙ্গের মুখ, কর্ণগড়ে দেবী মহামায়ার মন্দির পর্যন্ত প্রসারিত ছিল সুড়ঙ্গটি।

ইতিহাস জড়িয়ে আছে যে মন্দিরের পরতে পরতে, ভারী দুরবস্থা তার আজ। অবিলম্বে এই মন্দিরের সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।


Comments

Popular posts from this blog

Ram Sita Coin from Akbar's Era

Jagannath Mandir, Mirgoda, Purba Medinipur

Manasa Mangal Kavya