Khuki Kali Mandir, Budge Budge, South 24 PGS
খুকী কালীমন্দির পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বজবজ শহরে অবস্থিত একটি বিখ্যাত কালী মন্দির। মন্দিরের ঠিকানা হল চার কালী টেম্পল রোড, বজবজ।
বজবজে চিত্রগঞ্জের শ্মশানে আটচালা খুকী কালীমন্দির অবস্থিত। কষ্টিপাথর নির্মিত এক ফুট উচ্চ চতুর্ভূজা ত্রিনয়না দেবী বিগ্রহের পদতলে শিব অনুপস্থিত।
একক কালীমূর্তি, শিববিহীন: সাধক কমলাকান্তের উপাস্য কালীই সম্ভবত আজ বজবজ চিত্রগঞ্জের শ্মশানকালী, লোকমুখে যিনি খুকি কালী বলে পরিচিত।
কথিত আছে সাধক কবি কমলাকান্ত বর্ধমান রাজবাড়ির কাছেই বর্ধমানরাজের উদ্যোগে নির্মিত পীঠস্থানে শিববিহীন একক মা কালীর উপাসনা করতেন, এবং এই মা কালীকে তিনি নিজের বুকের উপর স্থাপিত করে পুজো করতেন। যদিও প্রত্যেকবার পুজোর সময় মা কালীর মৃন্ময়ী মূর্তি স্বহস্তে কমলাকান্ত তৈরি করতেন বলে আমরা জানি, কিন্তু এমন একটি কষ্টিপাথরের কালীমূর্তি বজবজ চিত্রগঞ্জ শ্মশানে গত একশ ত্রিশ বছর ধরে পূজিত হয়, যেটি শিববিহীন, এবং এ মূর্তি সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এটিই বর্ধমান রাজের উদ্যোগে কষ্টিপাথরে নির্মিত কমলাকান্ত কালী।
বলা হচ্ছে যে সাধক কমলাকান্ত প্রয়াত হওয়ার (১৮২১ সাল নাগাদ তাঁর মহাপ্রয়াণ) অনেক পরে বর্ধমানে কমলাকান্ত কালীবাড়ির এই মা কালী অপহৃত হন ডাকাত দলের হাতে, এবং এই ডাকাত দল পরে তাদের অমঙ্গল আশঙ্কায় বজবজ অঞ্চলে গঙ্গার ধারে দয়াল ঠাকুর নামে এক কালীভক্ত তন্ত্রসাধকের কাছে মায়ের মূর্তিটি রেখে পলায়ন করে। সময়টা ১৮৯২-৩ সাল। দয়াল ঠাকুর মাতৃভক্ত ছিলেন, তন্ত্রদীক্ষায় দীক্ষিত ছিলেন, কিন্তু অব্রাহ্মণ ছিলেন বলে নিজে মন্দির স্থাপনা না করে তাঁর গুরু পূর্ণানন্দ স্বামীকে দিয়ে পঞ্চমুণ্ডি আসন নির্মাণ করিয়ে মায়ের অধিষ্ঠান করেন।
শিয়ালদা দক্ষিণ শাখায় বজবজ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন। গঙ্গার তীরে চিত্রগঞ্জ শ্মশানে আটচালা মন্দিরে এক ফুট উচ্চতার কষ্টিপাথরের মা কালী পূজিত হন, মূর্তিটি মনোলিথ, অর্থাৎ একটি অখণ্ড কষ্টিপাথর কেটে তৈরি, কোথাও কোনও জোড়া নেই। ইনি লোকমুখে খুকি কালী বলে পরিচিত হয়েছেন, কারণ কালিকানন্দ স্বামী নামে এই মন্দিরের প্রথম পুরোহিত জানা যায় মা কালীকে খুকি মা বলে সম্বোধন করতেন। দয়াল ঠাকুর তাঁর গুরু পূর্ণানন্দকে দিয়ে মন্দির স্থাপন করিয়ে পুজোর ভার দিয়েছিলেন কালিকানন্দকে। প্রসঙ্গত তারাশঙ্কর রচিত বিখ্যাত আত্মজৈবনিক উপন্যাস ধাত্রীদেবতায় গোঁসাইবাবা চরিত্রটি এই কালিকানন্দ স্বামী (অন্য নাম রামজি মহারাজ)র আদলে রচিত। তারাশঙ্কর নিজেও বজবজে এই কালীমন্দিরে কয়েকবার এসেছেন, এবং এখানে কালিকানন্দ স্বামীর সমাধি তিনিই নির্মাণ করে দিয়েছেন।
মা কালী হলেন আদ্যা নিত্যা জগদকারণ অব্যক্ত প্রকৃতি। তাঁর একক মূর্তি উপমহাদেশে মাতৃধর্মের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও দ্যোতনা বহন করে। শিবের সঙ্গে জগন্মাতার স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক অনেক পরে রচিত, এটি সপ্তম শতকে শশাঙ্কযুগে ঘটে। সেজন্যই আমরা দেখি ষষ্ঠ শতকে শ্রীশ্রী চণ্ডী লিখিত হওয়ার সময়েও শিবের সঙ্গে প্রকৃতিমাতৃকাশক্তির কোনও বিশেষ সম্পর্ক নেই।এই প্রসঙ্গে আমি আগে লিখেছি।
বস্তুত হরপ্পা সভ্যতায় যে মূর্তিকে প্রোটো শিব আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, সে মূর্তিটি সম্পর্কে এখন গবেষক মহলে ঐক্যমত্য এই যে তিনি হরপ্পা সভ্যতায় তন্ত্রধর্মের পুরোহিত ছিলেন। যোগী শব্দের আদি অর্থ হল যিনি (মায়ের) পুজোর যোগান দেন, অর্থাৎ পুজোর পুরোহিত। এবং এই অর্থেই যোগী ও যোগিনী শব্দ ব্যবহৃত: উপাস্য মাতৃকার গণ বা সঙ্গীসাথী (সুকুমার সেন দ্রষ্টব্য)। শিব অবশ্যই আদিযোগী, কিন্তু এই নির্দিষ্ট অর্থে: তিনি মায়ের আদি উপাসক, আদি পুরোহিত, আদি অনুগামী। এজন্য আদিযোগী শিবের সঙ্গে উপাস্য জগন্মাতার প্রথম যে সম্পর্ক কল্পিত হয়েছিল, তা হল মা আর সন্তানের। তারার কোলে শিশু শিব। আজও তারাপীঠে যে মূর্তি পূজিত।
কিন্তু মা কালীর সঙ্গে শিবের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে আরও অনেক পরে। মা চামুণ্ডা (এবং মা কালীর) পায়ের তলায় পালযুগে একটি শব থাকত। বেশ কয়েক শতাব্দী পরে এই শবটিকে শিব বানিয়ে দেওয়া শুরু হয়, ইচ্ছাকৃত অথবা ভুলবশত।
কাজেই এই শিববিহীন কালীমূর্তি আদিমাতৃকার একক ও সর্বোচ্চ উপাসনার সুপ্রাচীন স্মৃতিবাহী বলে অনেকে মনে করে।
এই শিববিহীন কালীমূর্তি কমলাকান্ত পূজিত কালীমূর্তিই কি না, সেটা নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না, সমকালে বর্ধমানের ইতিহাস যাচাই করে দেখতে হবে ওই সময়ে বর্ধমানে কমলাকান্ত কালীবাড়িতে কোনও ডাকাতি ও কালীমূর্তি অপহরণের নথি পাওয়া যাচ্ছে কি না। কিন্তু নিশ্চিত করে যেটা বলা যায়, তা হল, এই স্বল্প পরিচিত কালীবাড়িটি বাঙালির মাতৃধর্মের সমগ্র মানচিত্রে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
এ মন্দিরে নিত্যপুজো হয়। কার্তিকী অমাবস্যায় যথারীতি বিশেষ উৎসব। হাঁড়িকাঠে বলি হয়।
Comments
Post a Comment