Maa Dhakeshwari, Kumartuli, Kolkata
মা ঢাকেশ্বরী দুর্গা, কুমারটুলি, কলকাতা।
দেশভাগের ফলে বাঙালির সঙ্গে সঙ্গে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল বাঙালির সভ্যতা কৃষ্টি সংস্কৃতি ধর্ম ও ঐতিহ্যকে। স্বয়ং পূর্ববঙ্গের প্রধান নগরের নগরেশ্বরীকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। কালীক্ষেত্র কলকাতায় এসে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন মা ঢাকেশ্বরী, যিনি ঢাকার স্থানেশ্বরী রক্ষাকর্ত্রী অঞ্চলমাতৃকা, যাঁর নামেই মধ্যযুগে ঢাকা নগরের নাম হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুযায়ী বল্লাল সেন এই মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঢাকার আদি মন্দির, কলকাতায় অধিষ্ঠিত মাতৃমূর্তি, প্ৰচলিত কিংবদন্তি এবং নথিবদ্ধ তথ্যগুলি নিম্নলিখিত পর্যায়ে বিন্যস্ত করতে পারি:
ঢাকেশ্বরী হলেন দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী মাতৃমূর্তি, কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী পরিবেষ্টিত। সিংহটি ঘোটকাকৃতি। মূর্তিমণ্ডলটি ধাতব, দেড় ফুট উচ্চতা।
এই মূর্তির নির্মাণশৈলী সেনযুগের নয়।
বল্লালসেন পূর্বে কামরূপ থেকে পশ্চিমে মিথিলা, দক্ষিণে উৎকল থেকে উত্তরে বরেন্দ্র পর্যন্ত সুবিশাল সেন সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। "নৃপেষু বল্লাল শ্রেষ্ঠ" বলা হয়েছে। তিনি ঢাকা নগরের পত্তন করে যে স্থানেশ্বরী মাতৃকার স্থাপনা করবেন, সে মূর্তি সুবৃহৎ হওয়ার কথা। প্রতিমাশৈলী হওয়ার কথা যুগানুগ। সে মূর্তি ইসলামিক আগ্রাসনে বিনষ্ট হওয়ারই সম্ভাবনা। বস্তুত ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণশৈলী মধ্যযুগের, কোনওমতে সেনযুগের নয়। সেনযুগের মন্দির বা মাতৃকা কেউই বধ্যভূমি মধ্যযুগে অক্ষত থাকেন নি, এরকম সিদ্ধান্ত করতে হবে।
এই ঢাকেশ্বরী মূর্তি মধ্যযুগে পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু করে কোনও এক সময় নির্মিত বলে অনেকে মনে করে।
বল্লাল সেনের শাক্ত খ্যাতি আছে যা বাংলার ইতিহাসের অন্যতম প্রখ্যাত কিংবদন্তি। শুধু ঢাকেশ্বরী নয়, কালীক্ষেত্র কলকাতায় কালীঘাটের মাতৃকার অধিষ্ঠান কিংবদন্তিও বল্লালসেনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
অতএব বল্লালের সঙ্গে ঢাকেশ্বরী প্রতিষ্ঠা ও ঢাকার নগরস্থাপনা কিংবদন্তি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে বর্তমানে পূজিত ঢাকেশ্বরী মা, এবং ঢাকার মন্দির, দুটির নির্মাণশৈলীই মধ্যযুগের।
আর একটা বিষয় হল, মায়ের নামের অর্থ। বাংলা জুড়েই আমাদের উপাস্য মায়ের নামের আগে বাদ্য বা গীত বা নৃত্যসূচক শব্দের ব্যবহার দেখা যায় (ঘাগরচণ্ডী দ্রষ্টব্য)। ঢাক বাজিয়ে মায়ের উপাসনা আজও হয়। সেজন্য ঢাকেশ্বরী শব্দটির অন্যান্য অর্থ খুঁজতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঢাকের বাজনা যে মায়ের প্রিয়, যাঁর উপাসনায় ঢাকের বাদ্যি বাজে, তিনিই ঢাকেশ্বরী দুর্গা। প্রসঙ্গত চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় প্রাপ্ত বাইশ শো বছর পুরোনো একটি মৃৎফলকে মা দশায়ুধার পুজোয় ছাগবলি-সহ ঢাকের বাজনার অনুষঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে।
দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের ওপরে অনবরত আক্রমণ হচ্ছিল (যে হানাদারির উত্তরাধিকার আজকের বাংলাদেশ সমানভাবে বহন করে)। এমতাবস্থায় ঢাকা শহরে মায়ের মন্দির আক্রান্ত হতে পারে এই আশঙ্কায় (আশঙ্কা অমূলক ছিল না, এ মন্দির পাকিস্তান আমলে সত্যিই বিধ্বস্ত হয়েছিল) বিশেষ বিমানে মা ঢাকেশ্বরীকে কলকাতা নিয়ে আসা হয় ১৯৪৮ সালে। ব্যবসায়ী দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাড়িতে মাকে রাখা হয়, এরপর তিনিই বর্তমান মাতৃমন্দিরটি স্থাপনা করেন কুমারটুলি অঞ্চলে, এবং ১৯৫০ সালের ২৬শে মার্চ মায়ের প্রতিষ্ঠা হয়।
কলকাতায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পশুবলি হয় না, সন্ধিপুজোয় এখানে চালকুমড়ো বলি হয়। সেই সঙ্গে নবরাত্রি পালিত হয় এই মন্দিরে।
Comments
Post a Comment