Siddheshwari Mandir, Siddheswari Village, Cooch Behar
সিদ্ধেশ্বরী মন্দির বা দ্বিতীয় কামাখ্যা পীঠ
কুচবিহার জেলার শক্তিপীঠ গুলির মধ্যে সিদ্ধেশ্বরী অন্যতম শক্তিপীঠ ।দেবী সিদ্ধেশ্বরীর নামেই মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলের নাম সিদ্ধেশ্বরী ।টেরাকোটা কারুকার্য বিশিষ্ট মন্দিরের কারুকার্য বা শৈলী কুচবিহারে বিরল।আটকোনাযুক্ত দেওয়ালের উপর গম্বুজ শোভিত মন্দির কুচবিহার জেলায় অন্যত্র কোথাও দেখাই যায় না। পশ্চিমবঙ্গের দু'একটি জেলায় এরকম কারুকার্য যুক্ত মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া যায়। বীরভূমের কিছু মন্দিরের কারুকার্যে এরকম নিদর্শন লক্ষণীয়।মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৩২ ফুট ।পুরনো আমলের সরু ইট দিয়ে তৈরি এবং আটকানোযুক্ত মন্দিরের উপরে রয়েছে একটি গম্বুজ । গম্বুজের উপর আমকলস ও ত্রিশূল লাগানো আছে। মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে প্রায় ৬ফিট সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়। গর্ভগৃহের মেঝেতে মার্বেল পাথর লাগানো আছে। গর্ভগৃহে সিংহাসনের উপর অষ্টধাতু নির্মিত সিদ্ধেশ্বরী দেবীমূর্তি উপবিষ্টা আছেন ।দেবীর উপরের দুই হাতের আঙ্গুলে মুদ্রা (কর্তরী ও খড়গ)এবং নিচের দুই হাতে দর্পণ ও অভয় মুদ্রা। দেবীর ভৈরব হল সিদ্ধেশ্বর। সিদ্ধেশ্বর গর্ভগৃহের মেঝেতে অবস্থিত খোদিত এক শিবলিঙ্গ বিশেষ।দেবীর নিত্য পূজা হয় ।বিশেষ তিথি যেমন দুর্গাপূজা, কালীপূজা, অমাবস্যার এবং সংক্রান্তি ছাড়াও অম্বুবাচীতে বিশেষ পূজার আয়োজন হয়ে থাকে।
মন্দিরের পশ্চিম প্রান্তে প্রাচীরবেষ্টিত একটি প্রাচীন কামরাঙা গাছ আছে। গাছটির গোড়া সুতো দিয়ে বাঁধানো এবং গোড়াতে সিঁদুর লিপ্ত কয়েকটি শিলাখণ্ড আছে। এই কামরাঙা গাছটি দেবী কামাখ্যার প্রতীক এবং পীঠস্থান রূপে পূজিত হয়। দেবী কামাখ্যা দর্শনের অভিশাপ থাকায় তৎকালীন কুচবিহার রাজ্যের মহারাজগণ,রাজগণ বর্তমান জেলার রাজজ্ঞাতী বা রাজগণ এই কামরাঙা গাছেই দেবী কামাখ্যাকে দর্শন করেন এবং পূজা দেন।
কুচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা নরনারায়ন ধ্বংসপ্রাপ্ত কামাখ্যা মন্দির তার ভাই শুক্লধ্বজ (চিলারায়) এর সাহায্যে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেছিলেন ।মহারাজা নরনারায়ণ এবং তার ভাই চিলারায় মা কামাখ্যার বিশেষ ভক্ত ছিলেন ।মহারাজা কামাখ্যা দেবীর সেবাপূজা করার জন্য মৈথিল ব্রাহ্মণ আনয়ন করেছিলেন এবং তাদেরকে ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন । মন্দিরের ব্যয় নির্মাণের জন্য দেবোত্তর ভূমি,সেবকগণ এর ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত জমি ও দান করেছিলেন। কামাখ্যা দেবীর অম্বুবাচী এবং দুর্গাপূজা উপলক্ষে কুচবিহার থেকে নিয়মিত নির্মাল্য পাঠানো হতো। জনশ্রুতি আছে, সন্ধ্যা আরতির সময় ঘণ্টার তালে তালে দেবী কামাক্ষা নগ্নমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে নৃত্য করেন । একদিন মহারাজ নরনারায়ন কেন্দুকলাই নামক পূজারীর সাহায্যে আড়াল থেকে নৃত্যরতা দেবীকে দর্শন করেন।মা কামাখ্যা এই বিষয়ে অবগত হয়ে অভিশাপ দেন-
"অতঃপর বেহাররাজগণের কামাখ্যা এবং নগ্ন দেবমূর্তি দর্শন নিষিদ্ধ"
অর্থাৎ কুচবিহার রাজবংশের সকলকে কামাক্ষা দেবীর মন্দির দর্শন নিষিদ্ধ করে দেন ।পূজারী ব্রাহ্মণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।
একই কারণে কুচবিহার রাজগনদের গোসানিমারির(কামতাপুর)কামতেশ্বরী দর্শন ও নিষিদ্ধ হবার জনশ্রুতি আছে ।
অভিশাপ প্রাপ্ত হয়ে মহারাজা নরনারায়ণ অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করে বলেন যে, তার অপরাধে তার বংশধরেরা মায়ের মূর্তি দর্শন ও পূজা দেওয়া থেকে কেন বঞ্চিত হবে ।এতে মা কামাখ্যা সদয় হয়ে বলেন,তিনি বানেশ্বর শিব মন্দির এর কাছে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের দেবী বিগ্রহে এবং পাশে প্রাচীন কামরাঙাবৃক্ষে দেবীরূপে সর্বদা বিরাজ করবেন। মহারাজগন এবং রাজগণ সেখানে পূজা দিলে মা কামাখ্যার দর্শন ও পূজা দেওয়া হবে।
মহারাজা নরনারায়ণের অভিশাপপ্রাপ্তির পর থেকে কোন মহারাজা বা রাজগণ আজ পর্যন্ত গোহাটি অবস্থিত মা কামাখ্যা দেবীকে দর্শন করেননি।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের প্রকৃত নির্মাতাকে এ বিষয়ে এখনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মন্দিরের প্রবেশ পথের দরজার উপর লেখা আছে ১২৮৪ সালে প্রথম মন্দির সংস্কার(মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন এর রাজত্বকালে )।উত্তরমুখী এই মন্দিরের সামনে একটি পাকা চত্বর আছে।এই পাকা চত্বর এবং তৎসংলগ্ন মন্দির এলাকা নিয়মিত সংস্কার না হওয়ার ফলে প্রাচীন এই মন্দিরের অবস্থা খুবই করুন ।মন্দিরের সামনে একটি পুকুর আছে,এটারও সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন। দেবত্র ট্রাস্ট পরিচালিত এই মন্দিরে বর্তমান জায়গার পরিমাণ ৩বিঘা কয়েক ধুর(বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরানো ) এবং এর বাইরে কিছু জমি এখনো আছে।
অসমের নলবাড়ি নিবাসী কামরুপী ব্রাহ্মণরা এখানে বংশপরম্পরায় পূজা করে আসছেন। বর্তমান পুরোহিত ধীরেশ্বর দেবশর্মা বলেন,স্বপ্ন প্রদত্ত মন্ত্র দিয়ে দেবী সিদ্ধেশ্বরীকে আরাধনা করা হয়।নিত্য পূজা হয় নিয়মিত সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশেষ পূজাদি হয়ে থাকে।মূল মন্দির ছাড়াও এখানে একটি ভোগ ঘর, যাত্রী ঘর, পুলিশ ঘর আছে।কিছু প্রাচীন গাছ এখনো মন্দির চত্বরে দেখা যায়।দেউড়ি হিসেবে বর্তমানে দায়িত্বে আছেন গোপাল বর্মন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে এলাকাবাসীর মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা দেখা দেয় এবং ভক্তসমাগম হয় প্রচুর ।
Comments
Post a Comment