Burakali, Balurghat, Dakshin Dinajpur


 মা বুড়াকালী, বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর।


দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট নগরে কুঠিকাছারি অঞ্চল চারশ বছর আগে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। সেই সময় এক তন্ত্রসাধক মা বুড়াকালীর বিগ্রহ খুঁজে পান। একটি নারায়ণ এবং শীতলা প্রতিমাও পেয়েছিলেন তিনি কাছেই, এক বটগাছের নীচে। মা বুড়াকালীর সঙ্গে অপর দুই দেবতাকে নিয়ে একটি  মাতৃমন্দির স্থাপনা করেন তিনি আত্রেয়ী নদীর ধারে। সেই থেকে মা এখানে অধিষ্ঠিত। 


মা বুড়াকালী বালুরঘাট নগরের স্থানেশ্বরী, তিনি এই নগরের অধিষ্ঠাত্রী রক্ষাকর্ত্রী মাতা।


দক্ষিণ দিনাজপুর হল বাঙালির আবহমানকালের তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃকা উপাসক সভ্যতার সুপ্রাচীন কেন্দ্র। বালুরঘাট থেকে সাইত্রিশ কিলোমিটার দূরে বাণগড়, সেখানে গঙ্গারিডাই যুগের মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে, অর্থাৎ আজ থেকে বাইশ-তেইশ শো বছরের পুরনো দশায়ুধা মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে, সে মূর্তি বর্তমানে কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে আছে, আমার প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রসঙ্গত গঙ্গারিডাই সভ্যতার সবথেকে জনপ্রিয় এই মাতৃকার মাথার খোঁপার পেছনে চুলের কাঁটার মত কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্রাকৃতি আয়ুধ থাকত, সংখ্যার বিচারে প্রায়ই দশটি আয়ুধ দৃশ্যমান, এজন্য দশায়ুধা নামে এই মাকে ডাকি। উত্তরে বাণগড় থেকে দক্ষিণে চন্দ্রকেতুগড় অবধি এই মায়ের মূর্তি খ্রিষ্টপূর্ব যুগে পাওয়া গেছে, যদিও কোনও সংস্কৃত শাস্ত্র এঁর ধ্যানমন্ত্র জানায় না, এঁর কোনও মূর্তিকল্প প্রকাশ করে না। 


এই অঞ্চল পালযুগে বরেন্দ্রভূমি, অর্থাৎ পালদের জনকভূ। এখানে পালযুগের নানা নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখানেই চর্চিকা স্তব করে রাজা নয়পালের শাসনকালে বাণগড় প্রশস্তি রচিত হয়। রাজা মহীপাল এখানেই কোথাও তাঁর ভবানী মন্দির স্থাপন করেন, যা কিনা পালযুগের বাংলায় প্রথম দুর্গা মন্দির। এই দিনাজপুর থেকে পালযুগের চামুণ্ডা/চর্চিকা মূর্তি-সহ নানা মাতৃপ্রতিমা পাওয়া গেছে।


মধ্যযুগেও এই অঞ্চলের অসীম গুরুত্ব। রাজা গণেশ তাঁর এক কায়স্থজাতীয় উপপত্নীর গর্ভজাত কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেন হরিরাম ঘোষের। জামাতা হরিরাম ঘোষের উপাধি হয় দিনরাজ, এবং জামাতাকে উপহারপ্রদত্ত ভূখণ্ডের নাম হয় দিনরাজপুর। সেই দিনরাজপুর থেকেই আজকের দিনাজপুর নাম এসেছে।


মা বুড়াকালী কাজেই এই অঞ্চলের সুপ্রাচীন মাতৃকা উপাসনার ঐতিহ্য বহন করেন। আদ্যা নিত্যা প্রকৃতিমাতৃকা, যিনি প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকেই মানুষের ঊষালগ্নে প্রথম সুসংহত ধর্ম ও উপাস্যের ধারণা দেন, সেই পৃথিবীমাতৃকা বিভিন্ন সংস্কৃতিতেই বৃদ্ধামাতা বলে আখ্যা পান। কারণ জগন্মাতা পরম মমতায় আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন অনাদি অনন্তকাল ধরে। তাই তিনি আদ্যিকালের অতিবৃদ্ধা। এই প্রসঙ্গে আসানসোলের অধিষ্ঠাত্রী মা ঘাগরবুড়ি স্মরণীয়।


বালুরঘাটের মা বুড়াকালীর বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় না, বিগ্রহ সর্বদা ঢাকা থাকে। বিগ্রহের ওপরে স্থাপিত রুপোয় নির্মিত মায়ের মুখমণ্ডল দেখা যায়। মায়ের মাথায় মুকুট সহ সোনারুপোর নানা অলঙ্কারে মাকে সাজিয়েছেন ভক্তরা। একবার দীপান্বিতা কার্তিকী অমাবস্যায় পাঁচ কেজি সোনার অলঙ্কারে মাকে ভূষিত করা হয়েছিল। মা জাগ্রত বলেই নিত্যপুজোয় এ মন্দিরে ভক্তদের নিয়মিত আনাগোনা। প্রসঙ্গত এ মন্দিরে বছরখানেক আগে প্রণামীর মুদ্রা এত বেশি জমা পড়ে যে স্থানীয় ব্যাংক এত মুদ্রা নিতে অস্বীকার করেছিল বলে আনন্দবাজারে খবর হয়।


ভক্তদের মানত করা ছাগবলি নিয়মিত হয় মা বুড়াকালীর মন্দিরে। তন্ত্রমতে মায়ের পুজো হয়, মায়ের পুজোয় শোল ও বোয়াল মাছ বলির প্রথা আছে। বর্তমানে শোল মাছের বদলে শুধু বোয়াল মাছ বলি দেওয়া হয় কুড়ি কেজি ওজনের।


বুড়াকালীর বর্তমান মন্দিরটি রাণী ভবানী কর্তৃক নির্মিত বলে জানা যায়। রাণী রাসমণিও এই মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন, আত্রেয়ী নদীতে বজরায় চেপে। মা বুড়াকালীর মন্দিরটি বালুরঘাট শহরের সবথেকে পুরোনো মন্দির বলে স্বীকৃত।

Comments

Popular posts from this blog

Dandesvara and Mahamaya Mandir, Karnagarh, West Medinipur

Manasa Mangal Kavya